ষষ্ঠ মহাবিদ্যা ছিন্নমস্তা দেবী কে ও দেবীর সম্পূর্ণ বিস্তারিত ইতিকথা

আজ আমরা জানতে পারবো  ষষ্ঠ মহাবিদ্যা ছিন্নমস্তা দেবীর কথা ও দেবীর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য

মহাছিন্নমস্তিকা ও তার ইতিহাসঃ

মহাছিন্নমস্তিকা  : উলঙ্গিনী দেবীমূর্তি। তিনি স্বহস্তে নিজ মস্তক ছিন্ন করে নিজ রক্ত নিজেই পান করেন। চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমানতার শক্তির প্রতীক।রতি এবং কামদেবের বুকের উপর দণ্ডায়মান দেবী ছিন্নমস্তা সম্পূর্ণ নগ্ন এবং তার গলায় ঝুলছে নরমুণ্ডের মালা। ভয়ঙ্কর ভয়াল রূপের এই ছিন্নমস্তা ধ্বংসের প্রতিরূপ।

দেবীর ইতিহাসঃ

                 এক হাতে নিজেরই কাটা মুণ্ডু, অপর হাতে কাতারি।কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে উঠেছে তিনটি রক্তের ধারা। দেবী নিজের ছিন্ন মুণ্ডকে রক্তপান করাচ্ছেন। রক্তপান করছেন, দেবীর দুই সখিও। আর দুই পায়ে দলছেন সংগমরত এই যুগলকে। এই রূপ আমাদের সকলেরই চেনা। হ্যাঁ, ইনিই দেবী ছিন্নমস্তা বা প্রচণ্ডচণ্ডিকা। দশমহাবিদ্যার অন্যতমা।

কে এই দেবী ছিন্নমস্তা?
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা  কেন উগ্রমূর্তি এক দেবীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেন?

কারণ, এই দেবী ছিন্নমস্তা আত্মবলিদান ও কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণের প্রতীক। অন্যদিকে তিনি একাধারে যৌনশক্তি ও যৌনসংযমের প্রতীক। আবার অপর এক দিক থেকে দেখলে, তিনি জগজ্জননীর জীবনদাত্রী ও জীবনহন্তী-এই দুই পরস্পরবিরোধী সত্ত্বার যুগলমূর্তি। বর্তমান নিবন্ধে তন্ত্র, পুরাণ ও আধুনিক গবেষকদের মতামত ঘেঁটে দেখব, ছিন্নমস্তার মূর্তিতে মাতৃসত্ত্বা, আত্মবিধ্বংসী ক্রোধ ও কামলালসার দমন-এই তিনটি আপাতবিচ্ছিন্ন ভাবধারা কেমন সুচারুভাবে গ্রথিত হয়েছে একটি মালায়।
দেবী ছিন্নমস্তা
দেবী ছিন্নমস্তা 


কোথা থেকে এলেন দেবী ছিন্নমস্তা?

দেবী ছিন্নমস্তার উৎস সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত। একটি মত অনুসারে, দেবী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে প্রবেশ করেছেন। অপর মতে, কালী প্রভৃতির মতো ছিন্নমস্তাও এক প্রাচীন বৈদিক দেবীর বিবর্তিত রূপ।
তান্ত্রিক ও তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের দেবী বজ্রযোগিনী বা বজ্রবারাহীর একটি ছিন্নমস্তক মূর্তি আছে। এই মূর্তির নাম ছিন্নমুণ্ডা। মূর্তিটি অনেকটা আমাদের ছিন্নমস্তার মতোই। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে দেবী ছিন্নমুণ্ডার একটি জন্মবৃত্তান্ত পাওয়া যায়: দুই বোন মেখলা ও কনখলা ছিলেন কৃষ্ণাচার্যের শিষ্যা। উভয়েই ছিলেন মহাসিদ্ধা। তাঁরা নিজেদের মাথা কেটে গুরুকে উপহার দেন এবং তারপর নৃত্য শুরু করেন।
দেবী বজ্রযোগিনীও ওইরকম মুণ্ডহীন বেশে এসে তাদের সঙ্গে নৃত্যে যোগ দেন। অপর একটি বৌদ্ধ কাহিনিতে পাই, গুরু পদ্মসম্ভবের এক শিষ্যা পূর্বজন্মে ছিলেন রাজকুমারী লক্ষ্মীঙ্করা। রাজশাস্তি গ্রহণ করে তিনি নিজের মাথা কেটে নগর পরিক্রমা করলে নগরবাসী তাঁকেই ছিন্নমুণ্ডা-বজ্রবারাহী রূপে পূজা করে।গবেষক বিনয়তোষ ভট্টাচার্য বৌদ্ধগ্রন্থ সাধনমালা (১১৫৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং হিন্দুগ্রন্থ ছিন্নমস্তাকল্প ও তন্ত্রসার (সপ্তদশ শতাব্দী) প্রভৃতি আলোচনা করে এই মত প্রকাশ করেছেন যে, বৌদ্ধদের ছিন্নমুণ্ডা ও হিন্দুদের ছিন্নমস্তা একই দেবী; পার্থক্য শুধু দেবী ছিন্নমস্তার নাগযজ্ঞোপবীত (সাপের তৈরি পৈতে) ও পায়ের তলায় শায়িত কামরতির মূর্তিতে। এই দুইটি ছিন্নমুণ্ডার মূর্তিতে অনুপস্থিত।সাধনমালা-য় দেবীর নাম সর্ববুদ্ধা এবং তাঁর সহচরীদ্বয়ের নাম বজ্রবৈরোচনী ও বজ্রবর্ণনী। আশ্চর্যজনক নামের মিল দেখা যায় তন্ত্রসার-এ। সেই গ্রন্থে তাঁর নাম সর্বসিদ্ধি এবং তাঁর সহচরীদের নাম ডাকিনী, বৈরোচনী ও বর্ণনী। দুই দেবী মিলে গিয়েছেন ছিন্নমস্তাকল্প-এ এসে। এই গ্রন্থে দেবীর নাম সর্ববুদ্ধি এবং তাঁর সহচরীদের নাম বজ্রবৈরোচনী ও বজ্রবর্ণনী। বিনয়তোষবাবুর মতে, সপ্তম শতাব্দীতে পূজিতা বৌদ্ধদেবী ছিন্নমুণ্ডাই হিন্দুদেবী ছিন্নমস্তার উৎস।
তবে বিনয়তোষবাবুর এই মত বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। শঙ্করনারায়ণ প্রমুখ গবেষক দেবী ছিন্নমস্তার বৈদিক যোগসূত্রটির অনুসন্ধান করেছেন। একটি মতে, বৈদিক দেবী নিঋতির বৈশিষ্ট্যগুলি পরবর্তী অর্থাৎ পৌরাণিক যুগে কালী, চামুণ্ডা, করালী, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি দেবীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়।
যে দুই হিন্দু ধর্মগ্রন্থে প্রথম দেবী ছিন্নমস্তার উল্লেখ পাওয়া যায়, সেদুটি বই হল মহাভাগবত পুরাণ (আনুমানিক ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) ও দেবীভাগবত পুরাণ (আনুমানিক ১১০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ)। দুটিই শাক্ত পুরাণ। এলিজাবেথ অ্যানি বার্নার্ডের মতে, উৎস যাই হোক না কেন, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে যে দেবী ছিন্নমস্তা বা ছিন্নমুণ্ডার পূজা প্রচলিত ছিল এবং মহাসিদ্ধারা তাঁর পূজা করতেন-একথা অনস্বীকার্য।

কারেল আর. ভ্যান কুইজ আবার তান্ত্রিক দেবী বারাহী ও চামুণ্ডার মধ্যেও ছিন্নমস্তার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। গবেষক ডেভিড কিংসলে কিন্তু মেনে নিচ্ছেন ছিন্নমস্তার বৌদ্ধ উৎসের কথা। তবে তাঁর মতে, সেটাই একমাত্র উৎস নয়। দেবী ছিন্নমস্তায় এসে মিশেছে অন্যান্য প্রভাবও। তাঁর মতে, মহাবিদ্যার ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিল আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দীতে। আর আগেও হিন্দু দেবমণ্ডলীতে নগ্ন ও কবন্ধাকার দেবীরা ছিলেন এবং ছিন্নমস্তার রূপের বিবর্তনে এঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

এই সব দেবীরা নাকি ছিলেন যৌনশক্তির প্রতীক; আর তাই তাঁদের যৌনাঙ্গের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই তাঁদের কবন্ধাকার কল্পনা করা হত-এমনটাই গবেষক কিংসলের মত। তবে তাঁর এই তত্ত্ব ছিন্নমস্তার সামগ্রিক রূপকল্পটির ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। কেউ কেউ বলেন যে, এমনও হতে পারে, কুচক্রী যুদ্ধদেবী কোটাভী ও দক্ষিণ ভারতীয় মৃগয়াদেবী কোরাভাই-এর রূপটি ছিন্নমস্তার রূপ কল্পনার পিছনে অনুপ্রেরণার কাজ করেছিল। কোনো কোনো মতে, কোটাভি মাতৃকা-নাম্নী দেবীমণ্ডলীর সদস্য। তিনিও নগ্না বা বিস্রস্ত বসনা এবং ভীষণাকার।

বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত পুরাণ মতে, তিনি বিষ্ণুর শত্রু। অন্যদিকে কোরাভাইও ভীষণাকার। তিনি যুদ্ধ ও বিজয়ের দেবী। সেই হিসেবে দু-জনের যোগ যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে। ছিন্নমস্তার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের কিন্তু কোনো যোগ নেই। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, হিন্দু পুরাণের নগ্না ও ভীষণাকৃতি দেবীরা দৈত্যরক্ত পান করে থাকেন। ছিন্নমস্তাই একমাত্র যিনি নিজের মুণ্ড ছিন্ন করে নিজেরই রক্ত পান করছেন।

⚜গল্পকথায় ছিন্নমস্তা
******************
তন্ত্রে-পুরাণে দেবী ছিন্নমস্তাকে ঘিরে বেশ অনেকগুলি উপকথা দানা বেঁধেছে। গুহ্যাতিগুহ্য তন্ত্র ও মুণ্ডমালা তন্ত্র-এ দশমহাবিদ্যার দশজন শক্তিদেবীকে বিষ্ণুর এক এক অবতারের উৎস রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত দুটি তন্ত্র মতে ছিন্নমস্তা যথাক্রমে নৃসিংহ ও পরশুরাম অবতারের উৎস।
মহাভাগবত পুরাণ-এ দশমহাবিদ্যার উৎপত্তির গল্পটি পাই: দক্ষের মেয়ে দাক্ষায়ণী (সতী) বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিবকে বিয়ে করেন। এহেন "লাভ ম্যারেজ" দক্ষ মোটেও মেনে নিতে পারেন না। কারণ, শিবকে তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।

⚜যাই হোক, কিছুদিন পর দক্ষ এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। নিজের মেয়ে-জামাইকে বাদ দিয়ে সকল দেবদেবীকে সেই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ জানালেন দক্ষ। দাক্ষায়ণী ভাবলেন বুঝি, কাজের বাড়িতে নানা কাজের চাপে বাবা তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে ভুলে গেছেন। তিনি বিনা নিমন্ত্রণেই যজ্ঞ দেখতে যাওয়ার জন্য শিবের অনুমতি চাইলেন। শিব কিন্তু শ্বশুরের মন বুঝেছিলেন। তিনি বললেন, "তোমার বাবা নিমন্ত্রণ করেননি। বিনা নিমন্ত্রণে যাওয়া কি ভাল দেখায়?"

⚜কিন্তু দাক্ষায়ণীও ছাড়বার পাত্র নন। শিব একটু জেদ করতেই তিনি শিবকে ভয় দেখাবার জন্য দশ মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করলেন। সেই দশ ভীষণাকার দেবীমূর্তি দশ দিক থেকে শিবকে ঘিরে ধরল। এই দশ মূর্তি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত। এঁদের মধ্যে ছিন্নমস্তা ছিলেন পশ্চিমে, শিবের ডানদিকে। শেষমেষ শিবকে স্ত্রীর আবদারের কাছে হার মানতেই হল। (কাহিনির পরবর্তী অংশ অনেকেরই জানা এবং এখানে অপ্রাসঙ্গিক বলে তা আর কথিত হল না) অপর একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব পার্বতীর প্রতি বীতরাগ হয়ে গৃহত্যাগ করতে চাইলে পার্বতী দশমহাবিদ্যার রূপ ধরে শিবের পথ রোধ করেন। দেবীভাগবত পুরাণ মতে, দশমহাবিদ্যা দেবী শাকম্ভরীর অংশসম্ভূতা ও তাঁর যুদ্ধসহচরী।

⚜নারদ পঞ্চরাত্র ও স্বতন্ত্র তন্ত্র থেকে দেবী ছিন্নমস্তা ও তাঁর দুই সহচরীর জন্মকাহিনি সংকলিত হয়েছে প্রাণতোষিণী তন্ত্র-এ। স্বতন্ত্র তন্ত্র মতে, একদা শিব ও চণ্ডিকা (পার্বতী) রতিসংগমে রত ছিলেন। চণ্ডিকা ছিলেন বিপরীত রতিতে। এমতাবস্থায় শিবের বীর্যস্খলন হলে চণ্ডিকা ক্রুদ্ধ হন। ক্রোধবশে তাঁর দেহ থেকে ডাকিনী ও বর্ণনী নামে দুই সহচরীর জন্ম হয়। কাহিনির পরবর্তী অংশ নারদ পঞ্চরাত্র ও স্বতন্ত্র তন্ত্র উভয় গ্রন্থেই পাওয়া যায়: মন্দাকিনী নদীতে (স্বতন্ত্র তন্ত্র মতে পুষ্পভদ্রা) স্নান করতে যাচ্ছিলেন দেবী পার্বতী। এমন সময় তিনি কামার্ত হয়ে পড়েন। কালো হয়ে যায় তাঁর গায়ের রং।

⚜এদিকে দেবীর দুই সহচরী ডাকিনী ও বর্ণনী (এঁরাই জয়া ও বিজয়া নামে পরিচিত) সেই সময় ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন। পার্বতী বাড়ি ফিরে তাঁদের খেতে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু সঙ্গিনীদের ক্ষুধার্ত অবস্থা দেখে তাঁর নিজেরই কষ্ট হয়। তখন তিনি নখের আঘাতে নিজের মস্তক ছিন্ন করে সঙ্গিনীদের রক্তপান করান। পরে সকলে বাড়ি ফিরে আসেন। দুটি লোকশ্রুতিও আছে দেবী ছিন্নমস্তাকে ঘিরে।

একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী: দেবাসুর যুদ্ধে দেবতারা মহাশক্তির সাহায্য প্রার্থনা করলে দেবী প্রচণ্ডচণ্ডিকা (শাক্তপ্রমোদ গ্রন্থের মতে প্রচণ্ডচণ্ডিকা ছিন্নমস্তারই অপর নাম) দেবতাদের সাহায্য করতে আসেন। দেবী ক্রোধোন্মত্তা হয়ে দৈত্যনাশ করেন। কিন্তু দৈত্যনাশের পরও তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়নি। এই অবস্থায় তিনি নিজের মাথা কেটে রক্তপান করেন। অপর লোকশ্রুতি অনুযায়ী, সমুদ্রমন্থনে উত্থিত অমৃতে অসুরদের ভাগটি দেবী ছিন্নমস্তা পান করেন এবং তা থেকে অসুরদের বঞ্চিত করার জন্য তিনি নিজের মাথাটি কেটে ফেলেন।

⚜এই চারটি গল্পের অর্থ কী ?
***********************
প্রাণতোষিণী তন্ত্র-এ উল্লিখিত গল্পদুটিতে ধরা পড়েছে মায়ের আত্মত্যাগের আদর্শটি। প্রথম লোকশ্রুতিটি আমাদের চিনিয়ে দেয় ক্রোধের আত্মবিধ্বংসী রূপটি। আর দ্বিতীয় লোকশ্রুতিটি লোকহিতার্থে আত্মত্যাগের আদর্শটিকে মহৎ করে তোলে।
ছিন্নমস্তা দেবী প্রত্যালীঢ় ভঙ্গীতে দন্ডায়মানা,গলায় তার নাগ যজ্ঞের উপবীত। সর্বদা ছিন্ন মস্তক ও খড়্গে ভূষিতা, দিগবসনা, নিজ কবন্ধের দ্বারা সানন্দে অমৃতকল্প রক্তধারা পানরতা, সর্পের মুকুট মনি দ্বারা ভূষিতা, ত্রিনয়না, বক্ষদেশ পদ্মে ভূষিতা, বিপরীত বিহারে রতা এবং দেবীর গাত্র বর্ণ জবা ফুলের ন্যায়। পীনোন্নত পয়োধরা, সদা ষোড়শ বর্ষীয়া। তাঁর একদিকে মুক্তকেশী লোহিতসৌম্যা, দিগম্বরী বর্ণিনী ও অন্যদিকে প্রলয় অগ্নির মতো ডাকিনী শক্তি। এঁরা দেবীর ছিন্ন কন্ঠের রক্তপানে রতা। দেবী ছিন্নমস্তার পদতলে সকাম রত মদন ও রতি দেবী থাকেন।

⚜ছিন্নমস্তা মহাবিদ্যা। এঁনাকে উগ্র মহাবিদ্যাও বলা হয়। 'নারদপঞ্চরাত্র' শাস্ত্র মতে এই দেবীর আবির্ভাবের একটি ঘটনা আছে।এই ছিন্নমস্তা দেবীর উদ্ভব সম্পর্কেও একটি কাহিনি এক পুরাণে আছে। নারদপঞ্চরাত্রের মতে, একদিন দেবী পার্বতী তাঁর দুই সহচরীদের নিয়ে মন্দাকিনীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর মনে হঠাত্ কামনা জেগে ওঠে, তার ফলে তিনি অনুরাগে রক্তবর্ণা হন। তাঁর সহচরীদ্বয়ও এই সময় ক্ষুধার্ত হয়ে তাঁর কাছে খাদ্য প্রার্থনা করেন। দেবী তাঁদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন বাড়ি গিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করব।

⚜কেন  তারা বারবার ক্ষুধার কথা জানিয়ে প্রার্থনা বা আবেদন করলে এই জয়া-বিজয়া-ডাকিনী-বর্ণিনী রূপে মায়ের দুপাশ থেকে খাদ্য প্রার্থনা করলে করুণাময়ী জননী তাদের এই প্রার্থনা শুনে নিজের বাম নখাগ্র দিয়ে নিজেরই মস্তক ছিন্ন করে সেটি নিজের বামকরতলে ধারণ করলেন। ছিন্ন মস্তক ও কণ্ঠ থেকে ত্রিধারায় রক্তস্রোত প্রবাহিত হতে লাগল। বাম ও দক্ষিণ দিক থেকে নির্গত দুটি ধারা দুই সখি জয়া ও বিজয়ার ভয়ঙ্করী মূর্তি ডাকিনী ও বর্ণিনীর ঊর্ধ্বমুখ লেলিহান জিহ্বায় সংযোজিত হল। আর মধ্যধারাটি নিজ ছিন্ন মুখে পড়তে লাগল। এই ভাবে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে সখীদের পরিতৃপ্ত করেছিলেন বলে তাঁর নাম হল ছিন্নমস্তা।

⚜কী অপার করুণা মায়ের! সন্তানদের ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর করতে তিনি স্বেচ্ছায় সানন্দে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে নিজ রক্তে তাদের পরিতৃপ্ত করেন। সহচরী গণ তৃপ্ত হলে দেবী কৈলাশে ফিরে গেলেন। পুনরায় তিনি হলেন শিব জায়া গৌরী।
⚜আপাতদৃষ্টে ছিন্নমস্তা ভয়ঙ্করী মূর্তি হলেও এর তাত্পর্য অসীম। পরিবর্তনশীল জগতের অধিপতি হচ্ছেন কবন্ধ। আর কবন্ধের শক্তি হলেন ছিন্নমস্তা। বিশ্বের হ্রাস বৃদ্ধি হয়েই চলেছে। হ্রাসের মাত্রা কম বিকাশের মাত্রা বেশী হলে  যেমন আবির্ভাব হয় দেবী ভুবনেশ্বরীর তেমন  আবার তার বিপরীত হলে ছিন্নমস্তার আবির্ভাব হয়।

দশমহাবিদ্যার প্রতিটি রূপের আলাদা অর্থ

⚜দশমহাবিদ্যার প্রতিটি রূপের আলাদা অর্থ আছে। বিদ্যার অর্থ কৌশল। তন্ত্রের দশমহাবিদ্যা দশ রকম সাধনার কৌশল ব্যক্ত করেছেন। ছিন্নমস্তা তত্ত্ব হল ব্রহ্মবিদ্যার কৌশল। 'ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পুর্নাত পূর্ণমুদচ্যতে' মন্ত্র টি ব্রহ্মের সর্বাবস্থায় পূর্ণত্ব বোধক। ছিন্নমস্তা তত্ত্ব ঐ পূর্ণত্বের প্রতীক। ছিন্নমস্তার আবার আত্ম বলিদান ও কুণ্ডলিনী জাগরণের প্রতীক। ছিন্নমস্তার শরীরে সর্প থাকে। সর্প কুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক। ছিন্নমস্তা কামরতা মদন রতির ওপর দাঁড়ানো। এর অর্থ মা কামনা বাসনাকে পদতলে দমন করছেন। মা হলেন পূর্ণ বৈরাগ্য ও ব্রহ্মচর্যের প্রতীক। তাই কেবল মাত্র ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসীরাই ছিন্নমস্তার পূজার অধিকারী।

⚜ছিন্নমস্তার কাটা মস্তক রক্তের ত্রিধারাকে ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার প্রতীক বলে ধরা হয়। কামকে দলন করে কুলকুণ্ডলীনির জাগরণকেই ব্যক্ত করে এই মূর্তি। ছিন্নমস্তার উৎস সন্ধান করতে হলে যেতে হবে 'মহাভাগবৎ পুরাণ'-এ। দক্ষ শিবরৃকে তাঁর যজ্ঞা আমন্ত্রন না জানানোয় ক্রুদ্ধ সতীদেবী দশ মহাবিদ্যের রূপ ধরেন। ছিন্নমস্তা তাঁদেরই অন্যতম। তাঁরা শিবকে কেন্দ্র করে দশ দিকে অবস্থান করেন। ছিন্নমস্তার অবস্থান শিবের ডানদিকে।
ছিন্নমস্তা দর্শনের পরেই রয়েছে রাজরাপ্পার দু'টি উষ্ণ প্রস্রবণ। এখানকার জল বহু রোগের উপশম ঘটায় বলে লোকবিশ্বাস।
⚜রাজরাপ্পা দেবী মন্দিরের ভৈরব হলেন রুদ্র মহাদেব। তিনিই এই মন্দিরে রক্ষক হিসেবে পূজিত। মন্দিরে দেবীর শিলারূপ বিদ্যমান। মূল মন্দিরকে ঘিরে মহাবিদ্যাদের অন্যান্য মূর্তিরও মন্দির এখানে রয়েছে। রয়েছে হনুমান ও সূর্যের মন্দিরও।
৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷   ধন্যবাদন্তে  MS


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>