শিবরাত্রি কি, কেন ও কিভাবে করবেন?শিবরাত্রির ব্রতকথা ও মাহাত্ম্য

সাধারনত শিবরাত্রি বা মহাশিবরাত্রি বলতে হিন্দু শৈব সম্প্রদায়ের নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বুঝানো হয়। এই মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। মহাশিবরাত্রি হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব ‘শিবের মহা রাত্রি’। অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার জন্য এই ব্রত পালিত হয়। অগণিত ভক্ত এইদিন শিবলিঙ্গে গঙ্গাজল, দুধ, বেলপাতা, ফুল দিয়ে পূজা অর্চনা মাধ্যমে পালন করে ।


ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী ও চতুর্দশী তিথিতে এ দেশের লক্ষ লক্ষ ভক্তের দ্বারা পরম পবিত্রতার সাথে পালিত হয় শিবরাত্রি। আসলে সারা বছরে মোট শিবরাত্রির সংখ্যা বারোটি, কিন্তু ফাল্গুনের এই তিথিটিই সবচেয়ে পবিত্র বলে গণ্য হয়। সমগ্র ভারতবর্ষের গ্রামে-শহরে ছড়ানো ছিটানো হাজার হাজার শিবমন্দির যেন ফাল্গুন মাসে জেগে ওঠে শিবরাত্রি উপলক্ষে। এদেশের অলিতে গলিতে অজস্র শিবমন্দিরের অস্তিত্ব হঠাৎ টের পাওয়া যায় ওম নমঃ শিবায় মন্ত্রের গুঞ্জরনে। হবে না-ই বা কেন, শৈব মতে, সব ব্রতের মধ্যে শিবরাত্রিকেই তো শ্রেষ্ঠ ব্রত বলে ধরা হয়। বলা হয় এই ব্রত পালন করলে নারীর সব কামনা পূর্ণ হয়ে যায়— পতিকামনা, পুত্রকামনা, বৈধব্য খণ্ডন ও সাংসারিক মঙ্গল ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই নারীদের এবং বিশেষভাবে কুমারী মেয়েদের কাছে এই ব্রত হয়ে ওঠে সুবর্ণ সুযোগ। সাধারনভাবে তারা শিবলিঙ্গে জল ঢেলে প্রার্থনা করেন শিবের মত স্বামী।

শিবরাত্রির ছবি
শিবরাত্রির সেরা ছবি

তবে কি এতবড় ব্রতের মাহাত্ম্য শুধু এটুকুই? শিবরাত্রি কি শুধুমাত্র মেয়েদের ব্রত? শিবরাত্রিতে জল ঢালার কারনই বা কি শিবলিঙ্গের মাথায় ?মর্তধামে শুরু হয় শিবরাত্রি ব্রত কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে ? শিবরাত্রি পালন করার নিয়ম কানুনগুলো কি কি? শিবরাত্রির ব্রতকথা শ্রবণ করলে কি হয়?এই ফাল্গুন চতুর্দশীর শিবরাত্রি কেন এত মহিমান্বিত সর্বমোট বারটি শিবরাত্রি থাকলেও?

এসকল প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসে উঁকি দেয় আমাদের মনের কোনে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়ত আমরা অনেকেই জানি আবার অনেকেই জানি না। যারা জানেন না তাদের জন্য এই ভিডিওটি অত্যন্ত মূল্যবান এবং কাঙ্ক্ষিত। আজ আপনাদের জন্য রইল শিবরাত্রির ব্রতকথা, শিবরাত্রি সম্পর্কিত যাবতীয় জিজ্ঞাসার উত্তর এবং সর্বোপরী শিবরাত্রি সম্পর্কিত সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য।

পুরাকালের কথা। তখন কৈলাশ পর্বতের শিখর ছিল সর্বরত্নে অলংকৃত। ছিল ছায়াসুনিবীড় ফুলে-ফলে শোভিত বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম ঢাকা। পারিজাতসহ অন্যান্য পুষ্পের সুগন্ধে চারদিক থাকত আমোদিত। এখানে সেখানে দল বেঁধে নৃত্য করে বেড়াত অস্পরারা। ধ্বনিত হত আকাশ গঙ্গার তরঙ্গ-নিনাদ। ব্রহ্মার্ষিদের কন্ঠ থেকে শোনা যেত বেদধ্বনি।

শিব-পার্বতী বাস করতেন সেই কৈলাশশিখরে ।তাঁদের সেবা করত গন্ধর্ব, সিন্ধ, চারণ প্রভৃতি ।শিব-পার্বতী ছিলেন পরম সুখে  । একসময় পার্বতী দেবাদিদেব শিবকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'ভগবান' আপনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ-দাতা। আপনি কোন ব্রত বা তপস্যায় সন্তুষ্ট হন?

দেবী পার্বতীর কথা শুনে শিব বললেন,

দেবী, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথীর রাত্রিকে শিবরাত্রি বলা হয়। এ রাত্রিতে উপবাস করলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হই। স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় আমি যতটুকু সন্তুষ্ট হই তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হই শিবরাত্রির উপবাসে। তিনি আরও বলেন, ব্রতপালনকারীরা ত্রয়োদশীতে স্নান করে সংযম পালন করবে। স্বপক্ব নিরামিষ বা হবিষ্যান্ন ভোজন করবে। স্থণ্ডিল তথা ভূমি বা বালু বিছানো যজ্ঞবেদী অথবা কুশ বিছিয়ে শয়ন করে আমার তথা ওম নমঃ শিবায় নাম স্মরণ করতে থাকবে। রাত্রি শেষ হলে শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃ ক্রিয়াদি করবে অন্যান্য আবশ্যক কার্যাদি করবে। সন্ধ্যায় যথাবিধি পূজাদি করে বিল্বপত্র সংগ্রহ করবে। তারপর নিত্যক্রিয়াদি করবে। অতঃপর যজ্ঞবেদীতে, সরোবরে, প্রতীকে বা প্রতিমায় বিল্বপত্র দিয়ে আমার পূজা করবে। একটি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করলে আমার যে প্রীতি জন্মে, সকল প্রকার পুষ্প একত্র করে অথবা   মুক্তা, প্রবাল,মণি, বা স্বর্ণনির্মিত পুষ্প দিয়ে আমার পূজা করলেও, আমার তাহারর সমান প্রীতি জন্মে না কেন।

প্রহরে প্রহরে বিশেষভাবে স্নান করিয়ে আমার পূজা করবে। পুষ্প, গন্ধ, ধূপাদি দ্বার যথোচিত অর্চনা করবে। প্রথম প্রহরে দুগ্ধ, দ্বিতীয় প্রহরে দধি, তৃতীয় প্রহরে ঘৃত এবং চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে আমাকে স্নান করাবে এবং পূজা করবে। এছাড়া যথাশক্তি নৃত্যগীতাদি দ্বারা আমার প্রীতি সম্পাদন করবে।

হে দেবী, এই হল আমার প্রীতিকর ব্রত। এ ব্রত করলে তপস্যা ও যজ্ঞের পুণ্য লাভ হয় এবং ষোল কলায় দক্ষতা জন্মে। এ ব্রতের প্রভাবে সিদ্ধি লাভ হয় এবং অভিলাষী ব্যক্তি সপ্তদীপা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়।

শিব পার্বতীকে আরও বলেন, এবার শিবচতুদর্শী তিথির মাহাত্ম বলছি, শোন।

একদা সর্বগুণযুক্ত বারাণসী পুরীতে ভয়ঙ্কর এক ব্যাধ বাস করত। বেঁটে-খাটো ছিল তার চেহারা, আর তার গায়ের রং ছিল কালো। চোখ আর চুলের রং ছিল কটা। নিষ্ঠুর ছিল তার আচরণ। ফাঁদ জাল, দড়ির ফাঁস এবং প্রাণী হত্যার নানা রকম হাতিয়ারে পরিপূর্ণ ছিল তার বাড়ি। একদিন সে বনে গিয়ে অনেক পশু হত্যা করল। তারপর নিহত পশুদের মাংসভার নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হল। পথে শ্রান্ত হয়ে সে বনের মধ্যে বিশ্রামের জন্য একটি বৃক্ষমূলে শয়ন করলে এবং একটু পরেই নিদ্রিত হল। সূর্য অস্ত গেল। এল ভয়ঙ্কর রাত্রি। ব্যাধ জেগে উঠল। ঘোর অন্ধকারে কোন কিছুই কারও দৃষ্টিগোচর হল না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে একটি শ্রীফলবৃক্ষ অর্থাৎ বিল্ববৃক্ষ পেল। সেই বিল্ববৃক্ষে সে লতা দিয়ে তার মাংসভার বেঁধে রাখল। বৃক্ষতলে হিংস্র জন্তুর ভয় আছে। এই ভেবে সে নিজেও ঐ বিল্ববৃক্ষে উঠে পড়ল। শীতে ও ক্ষুধায় তার শরীর কাপঁতে লাগল। এভাবে সে শিশিরে ভিজেই জেগে কাটাল সারা রাত।

দৈববশত সেই বিল্ববৃক্ষমূলে ছিল একটি শিবলিঙ্গ। তিথিটি ছিল শিবচতুর্দশী। আর ব্যাধও সেই রাত্রি কাটিয়েছিল উপবাসে। তার শরীরের ঝাঁকুনিতে কয়েকটি বিল্বপত্র পতিত হয়েছিল নিচের সেই শিবলিঙ্গের উপর। এভাবে উপবাসে বিল্বপত্র প্রদানে এবং শিশিরস্নানে নিজের অজান্তেই ব্যাধ পালন করল শিবরাত্রিব্রত। পরদিন উজ্জল প্রভাতে ব্যাধ নিজের বাড়িতে চলে গেল। বাড়িতে গিয়ে ভোজন করার আগে একজন অতিথির আগমন ঘটল তার গৃহে। অগত্যা ব্যধ তার নিজের খাবার তুলে দিল সেই অথিতির মুখে। ফলে তার শিবরাত্রি ব্রতের পারন ও সুসম্পন্ন হয়ে গেল।  দেবী, তিথিমাহাত্মে কেবল বিল্বপত্রে আমার যে প্রীতি হয়েছিল, স্নান, পূজা বা নৈবেদ্যাদি দিয়েও সে প্রীতি সম্পাদন সম্ভব নয়। তিথি মাহাত্মে ব্যাধ মহাপূণ্য লাভ করেছিল।

কালক্রমে ব্যাধের আয়ু শেষ হল। যমদূত তার আত্মাকে নিতে এসে তাকে যথারীতি যমপাশে বেঁধে ফেলতে উদ্যত হল। অন্যদিকে আমার প্রেরিত দূত যমদূতদের সাথে বাদানুবাদে লিপ্ত হল এবং অবশেষে ব্যাধকে শিবলোকে নিয়ে এল। আর আমার দূতের দ্বারা আহত হয়ে যমদূত যমরাজকে নিয়ে আমার পুরদ্বারে উপস্থিত হল। দ্বারে আমার অনুচর নন্দীকে দেখে যম তাকে সব ঘটনা বললেন। এই ব্যাধ সারা জীবন ধরে কুকর্ম করেছে। জানালেন যম।
তার কথা শুনে নন্দী বললেন, ধর্মরাজ, এতে কোন সন্দেহই নেই যে ঐ ব্যাধ একজন দুরাত্মা। সে সারা জীবন অবশ্যই পাপ করেছে। কিন্তু শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্মে সে পাপমুক্ত হয়েছে এবং সর্বেশ্বর শিবের কৃপা লাভ করেই শিবলোকে এসেছে। নন্দীর কথা শুনে বিস্মিত হলেন ধর্মরাজ। তিনি শিবের মহানুভবতার কথা ভাবতে ভাবতে যমপুরীতে চলে গেল। এবং এরপর থেকে শিবরাত্রি ব্রত পালনকারীদের উপর সমস্ত অধিকার ত্যাগ করলেন ধর্মরাজ যম। শিবের মুখে ব্রতকথা শ্রবণ করে বিষ্মিত হলেন শিবজায়া হিমালয় কন্যা পার্বতী। এই মহাপবিত্র শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম্য নিকটজনের কাছে বর্ণনা করলেন তিনি। তাঁরা আবার তা ভক্তি ভরে জানালেন পৃথিবীর বিভিন্ন রাজাকে। এ ভাবে শিবরাত্রিব্রত পৃথিবীতে প্রচলিত হল।

আপনি হয়ত জানেন না শিবরাত্রির এই দিনটিতেই শিব লিঙ্গরূপে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিলেন। পুরাণ বলছে, এই দিন শিব ও পার্বতীয় বিয়ে হয়েছিল। বলা হয়, এই দিনটিতে উত্তর গোলার্ধের আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের সংস্থান এমন হয়, যাতে মানুষ তার আধ্যাত্মিক এবং অন্যান্য শক্তি বিশেষ ভাবে জাগ্রত করে তুলতে পারে। শিব নিজে উমাকে বলেছিলেন, এই তিথি পালন করলে সমস্ত পাপের ফল থেকে নিষ্কৃতি মিলবে এবং মোক্ষলাভ হবে। শিবরাত্রির দিনেই মহাদেব তাণ্ডব নৃত্য করেছিলেন। আর তারপর থেকেই এই নৃত্য পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে যায়। শিবরাত্রির দিনের এই ব্রত শুধু অবিবাহিত মেয়েরাই নন, বিবাহিত মেয়েরা এমনকি ছেলেরাও এই ব্রত করতে পারেন। শুধু মহাদেবের মতো স্বামী চেয়ে বরই নয়, সাফল্য এবং সমৃদ্ধি চেয়েও এই ব্রত করা যায়। শিবরাত্রির ব্রত করলে অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। নিশীথ কলা বা যে সময়ে মহাদেব শিব লিঙ্গের রূপ ধারণ করেছিলেন, সেই সময়ই শিবরাত্রি ব্রত উদযাপনের উপযুক্ত সময়। মহাশিবরাত্রির ব্রত করলে রজঃ গুণ এবং তমোঃ গুণগুলির সংযম শক্তি বাড়ে। বলা হয়, শিবরাত্রিতে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠ করলে সমস্ত গ্রহের প্রকোপ থেকে রেহাই মেলে। আয়ু সঙ্কট থেকে বাঁচতেও এই মন্ত্র খুবই কার্যকরী। এছাড়াও এই ব্রতের ব্রতকথা শ্রবণ করলে মহাপূন্য লাভ করেন শ্রোতারা।

শিবরাত্রি,শিবরাত্রি ব্রত কথা,শিবরাত্রি ব্রত,শিবরাত্রি কেন পালন করা হয়,মহা শিবরাত্রি,শিবরাত্রি ব্রতকথা মাহাত্ম্য,শিবরাত্রি পূজা পদ্ধতি,শিবরাত্রি কি,শিবরাত্রি পূজা,শিবরাত্রি মাহাত্ম্য,শিবরাত্রি ব্রতকথা,শিবরাত্রি কেন করা হয়,মহা শিবরাত্রি ব্রত,শিবরাত্রির ইতিহাস,শিবরাত্রি পালনের নিয়ম,শিবরাত্রি পালনের নিয়ম,শিব চতুর্দশীর মাহাত্ম্য,শিবরাত্রি ব্রত কথা মাহাত্ম্য,শিবরাত্রির ব্রত কথা,শিবরাত্রি ২০২২,শিবরাত্রি 2022,শিবরাত্রি ব্রত নিয়ম

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>