হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান পুরাণ এবং বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থ ব্রহ্মবৈবর্ত
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থের ভিন্ন একটি পাঠ সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম সহস্রাব্দের শেষভাগে প্রচলিত ছিল। তবে এই গ্রন্থের অধুনা-প্রচলিত পাঠটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১৫শ বা ১৬শ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাঅঞ্চলে লিখিত হয়। ব্রহ্মকৈবর্ত পুরাণনামে পরিচিত একটি প্রায় সমোচ্চারিত শিরোনামবিশিষ্ট গ্রন্থেরও অস্তিত্ব রয়েছে। এটি সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের কোনো অঞ্চলে পরিমার্জিত হয়।এই পুরাণের অনেকগুলি পাঠ পাওয়া যায়। পাঠভেদে এই পুরাণের অধ্যায়সংখ্যা ২৭৪ বা ২৭৬। সব কটি পাঠকেই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বা ব্রহ্মকৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থের অংশ বা পাণ্ডুলিপি বলে দাবি করা হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এই পুরাণে কৃষ্ণকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর বলা হয়েছে এবং বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা, গণেশ প্রমুখ দেবতাদের একই দেবতার বিভিন্ন রূপ এবং কৃষ্ণের অবতার বলে উল্লেখ করা হয়েছে.এছাড়া এই পুরাণে রাধা, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, সাবিত্রী প্রমুখ দেবীদের ‘প্রকৃতি’র অবতার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাভারত ও দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থদুটিতে প্রাপ্ত কিছু উপাখ্যানও এই পুরাণে সংযোজিত হয়েছে।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এই পুরাণে রাধার মাধ্যমে নারীসত্ত্বাকে গৌরবোজ্জ্বল করা হয়েছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ |
ইতিহাস সম্পাদনাঃ
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও ভাগবত পুরাণ ভারতের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলির উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। এই জাতীয় একটি শিল্প হল উপরের ছবিতে দৃষ্ট মণিপুরের ‘রাসলীলা’ নৃত্য।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থের যে পাঠগুলি এখন পাওয়া যায়, সেটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই পুরাণে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যান্য অধিকাংশ প্রধান পুরাণে রাধার কোনো উল্লেখ নেই। এই পুরাণে রাধা ও কৃষ্ণের জীবন-কেন্দ্রিক কিংবদন্তি, পূজাপদ্ধতি, পৌরাণিক উপাখ্যান ও নাটকীয় ঘটনাগুলি নথিভুক্ত করেছে।
এছাড়া এই পুরাণে আলোচিত হয়েছে নীতিকথা, ধর্ম, চতুরাশ্রম বর্ণ ও মূল আখ্যায়িকার সঙ্গে যুক্ত উৎসবগুলির কথা।এই পুরাণে উল্লিখিত বিবরণগুলি থেকে বোঝা যায় যে, খ্রিস্টীয় ২য় সহস্রাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের তান্ত্রিকধারণাগুলির বিকাশ এবং চৈতন্য মহাপ্রভু প্রমুখ ভক্তিবাদী ধর্মগুরুদের সম্পর্কে পুরাণকার অবহিত ছিলেন বা এঁদের বা এগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অন্যান্য প্রধান পুরাণগুলি বিশ্বকোষতুল্য গ্রন্থ হলেও, এই পুরাণটি সেই রকম নয়। এই কারণে মনে করা হয় যে, এই পুরাণের মুখ্য অংশটি সম্ভবত ১৫শ বা ১৬শ শতাব্দীর রচনা।
যদিও তার আগেও এই পুরাণের অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করা হয়। এই পুরাণের প্রাচীনতর পাঠটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৮ম থেকে ১০শ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে সম্পূর্ণ হয়েছিল।হাজরার মতে,৭০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ এই পুরাণের একটি পাঠের অস্তিত্ব ছিল।যদিও পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে এই পুরাণ কয়েকবার বড়সড় পরিমার্জনার মধ্যে দিয়ে যায়। সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে এই পুরাণ পরিমার্জিত হয়।এই পুরাণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আরেকটি গ্রন্থ রয়েছে। সেটি হল ব্রহ্মকৈবর্ত পুরাণ। এটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে রচিত। তবে দক্ষিণ ভারতে এই পুরাণের অনেকগুলি পাঠ পাওয়া যায়। আদি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ নামে কয়েকটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। এগুলির রচনাকাল সঠিক জানা যায় না। এটিকেই সম্ভবত প্রাচীনতর ও মূল পুরাণ মনে করা হয়। তবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণনামে যে গ্রন্থটি ১৮টি মহাপুরাণের অন্তর্গত, তার থেকে এটির বিষয়বস্তু বিশেষ খুব আলাদা।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থের প্রাচীনতর পাঠটি অতীতে প্রভাবশালী ছিল। কারণ ১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীর নিবন্ধ গ্রন্থকারেরা স্মৃতিচন্দ্রিকাপ্রভৃতি গ্রন্থে এমন প্রায় ১,৫০০ শ্লোক উদ্ধৃত করেছিলেন, যা তারা এই পুরাণ থেকে গ্রহণ করেছেন বলে দাবি করেন।যদিও এর মধ্যে মাত্র ৩০টি শ্লোকই এই পুরাণের বর্তমান পাঠে পাওয়া যায়। তাই মনে করা হয়, ১৫শ বা ১৬শ শতাব্দীর পরে এই পুরাণের একটি বড়ো অংশ পুনর্লিখিত হয়েছিল।
হাজরার মতে, এই পুরাণের অন্তর্ভুক্ত স্মৃতিশাস্ত্র-মূলক অধ্যায়গুলি সম্ভবত ১৬শ শতাব্দীর পর সংযোজিত হয়।এই আধুনিক অংশে “বর্ণসংকর, নারীর কর্তব্য, বর্ণসমূহের কর্তব্য, আশ্রমধর্ম, পূজা ও ব্রাহ্মণ মাহাত্ম্য, নরক ও পরলোকতত্ত্ব এবং দান মাহাত্ম্য” বর্ণিত হয়েছে।প্রচলিত পাণ্ডুলিপির স্মৃতিশাস্ত্র-মূলক অধ্যায়গুলির মধ্যে মাত্র দুটি প্রাচীনতর পাঠগুলিতে পাওয়া যায়।এগুলি ব্রত-সংক্রান্ত।
বিন্যাসসম্পাদনা
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ চারটি ‘খণ্ড’ বা ভাগে বিভক্ত।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের খণ্ডসমূহ খণ্ড সংখ্যা অধ্যায় বিষয়ব্রহ্ম১৩০ ব্রহ্মপ্রকৃতি২৬৭ দেবীগণেশ ৩৪৬ গণেশ কৃষ্ণ ৪১৩১ থেকে ১৩৩ রাধা, কৃষ্ণ মোট ২৭৪ থেকে ২৭৬ কৃষ্ণ
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডটির নাম ‘গণেশখণ্ড’ বা ‘গণপতি খণ্ড’।প্রচলিত ধারণা ও অন্যান্য পুরাণের মতানুসারে, এই পুরাণে মোট ১৮,০০০ শ্লোক রয়েছে।তবে প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিগুলিতে আরও বেশি সংখ্যক শ্লোক পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, অন্যান্য পুরাণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রচলিত ধারণার থেকে প্রকৃতপক্ষে পুরাণের শ্লোকসংখ্যা কম। এখানে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র চোখে পড়ে।পদ্মপুরাণ এই পুরাণকে রাজসিক পুরাণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।তবে গবেষকদের মতে, পুরাণের এই ‘সত্ত্ব-রজঃ-তমো’ শ্রেণিবিভাগ “সম্পূর্ণ কাল্পনিক”। কারণে এই পুরাণে এমন কিছুই নেই, যা থেকে এটিকে রাজসিক পুরাণ বলা চলে।
বিষয়বস্তু সম্পাদনাঃ
কামদেবের অস্ত্রশস্ত্র আমি তোমাকে এই অস্ত্রগুলি দিচ্ছি:
সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন ও স্তম্ভন।
দয়া করে এখান থেকে কিছু গ্রহণ করুন এবং সকলকে মোহিত করুন।
এগুলির সাহায্যে তুমি হবে অপ্রতিরোধ্য।
—কামের প্রতি ব্রহ্মা
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, অধ্যায় ৪, শ্লোক ৩৫)
‘ব্রহ্মবৈবর্ত’ শব্দটির অর্থ ‘ব্রহ্মের রূপান্তর’। এখানে ব্রহ্ম বলতে কৃষ্ণকে বোঝানো হয়েছে।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে ব্রহ্মরূপী কৃষ্ণ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন এবং নিজেই ব্রহ্মাণ্ড হয়েছেন।ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তন ও প্রকৃতি উপস্থাপিত হয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের উপাখ্যানের মাধ্যমে। এই পুরাণের আদিরসাত্মক কাহিনি ও কিংবদন্তিগুলি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে (‘ব্রহ্মখণ্ড’) কৃষ্ণকে আদি স্রষ্টা, বিশ্বাত্মা ও ব্রহ্ম নামে পরিচিত সর্বোচ্চ সত্য রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।দ্বিতীয় খণ্ড বা ‘প্রকৃতিখণ্ডে’ রাধা, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও সাবিত্রী – এই পাঁচ দেবীর সমরূপত্ব পুরাণকথার মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হয়েছে।যদিও এখানে আরও অনেক দেবীরই পরিচয় দেওয়া হয়েছে,তবু শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক দেবী ও নারীসত্ত্বাকে রাধাপ্রকৃতির সমরূপ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।তৃতীয় খণ্ড বা ‘গণেশখণ্ডে’ জনপ্রিয় হিন্দু দেবতা গণেশেরজীবনকথা ও পরিবারবর্গের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই অংশে গণেশকে কৃষ্ণের অবতার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।এই পুরাণের শেষ খণ্ড বা ‘কৃষ্ণখণ্ড’ সম্পূর্ণত রাধাকৃষ্ণকেন্দ্রিক। এই অংশে আদিরসাত্মক বিভিন্ন বিবরণ, স্তবস্তোত্র, কিংবদন্তি ও পুরাণকথা বর্ণিত হয়েছে। এখানে রাধাকে কৃষ্ণের শক্তি ও অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থে নারী সম্পর্কে মুক্তচিন্তার প্রতিফলন লক্ষিত হয়। এই পুরাণে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক নারীসত্ত্বা এক দিব্য নারীসত্ত্বা থেকে উৎসারিত” এবং “এক নারীর অপমান দেবী রাধারই অপমানের নামান্তর” (প্রকৃতিখণ্ড, অধ্যায় ৪, শ্লোক সকল নারীকে রাধার সমতুল্য বলার সঙ্গে সঙ্গে এই পুরাণে সকল পুরুষকে কৃষ্ণের সমতুল্য বলা হয়েছে। এই অংশগুলি সম্ভবত হিন্দুধর্মের প্রাচীন শাক্ত সম্প্রদায়ের চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত।যদিও জোরিস বলেছেন যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণনারীবাদী গ্রন্থ নয়। কারণ, এখানে সবক্ষেত্রে মর্যাদার সঙ্গে রাধার বর্ণনা দেওয়া হয়েনি এবং তাকে “কৃষ্ণের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর বা কৃষ্ণের সমান মর্যাদাও দেওয়া হয়নি”
প্রতিক্রিয়াসম্পাদনা
ভাগবত পুরাণ গ্রন্থের মতো ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণগ্রন্থটির মূল উপজীব্য হলেন বিষ্ণু (বিশেষত কৃষ্ণ)। তবে এই পুরাণের কাহিনি ও কিংবদন্তিগুলি ভাগবত পুরাণ গ্রন্থের কাহিনিগুলির চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই পুরাণের রচনাভঙ্গিমাকে “বিবর্ণ ও শিশুসুলভ” বলে উল্লেখ করা হয়। এই পুরাণের বিষয়বস্তু ও কাহিনি-বিন্যাস অন্যান্য পুরাণের তুলনায় এতটাই পৃথক যে উইলসন লিখেছেন, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থটির ‘পুরাণ’ আখ্যা পাওয়ার সামান্যতম যোগ্যতাও নেই।
উইলসনের মতের বিরোধিতা করে পরমেশ্বরানন্দ লিখেছেন যে, একটি ভক্তিমূলকশাস্ত্রের ঝোঁক থাকে অতিন্দ্রিয় অনুভূতিগুলির দিকে। এই গ্রন্থও নিজের মতো করে ধর্মীয় ও দার্শনিক প্রশ্নগুলি আলোচনা করার চেষ্টা করেছে। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলিতেও একই ভাবে ঈশ্বর ও বিশ্বের দ্বৈতসত্ত্বা ও অদ্বৈতসত্ত্বা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থে নারী ও পুরষসত্ত্বার একত্ব, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও অবিচ্ছেদ্যতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের মাধ্যমে। এই গ্রন্থে শৈবধর্মের অর্ধনারীশ্বর ধারণার আদলে একটি ‘অর্ধনারী-কৃষ্ণ’ (বা ‘অর্ধ-রাধা-বেণুধর-মূর্তি’) ধারণার অবতারণা করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রেরএকটি কৃষ্ণমূর্তি এই ধারণা অবলম্বনে অর্ধ-পুরুষ ও অর্ধ-নারীর আকারে নির্মিত হয়।এই পুরাণের প্রথম খণ্ডটি (‘ব্রহ্মখণ্ড’) অসমীয়া ভাষায় অনুদিত হয়। এই অনুবাদের পাণ্ডুলিপিটি ১৯শ শতাব্দীর মধ্যভাগে লিখিত হয়েছিল।
এই পুরাণ বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্যের একটি অঙ্গ। যদিও ডিমোকের মতে, এই পুরাণ প্রামাণ্য পুরাণগ্রন্থের মর্যাদা পায় না।