সবচেয়ে পুরনো বৈদিক সংহিতা কোনটি

বৈদিক সাহিত্যে মহাবিশ্বঃ
বেদ হল প্রাচীন ভারতে রচিত একাধিক ধর্মগ্রন্থের একটি সমাহার। এটি রচনা করতে কয়েক শতবছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। সংস্কৃতে ‘বিদ্’ ধাতুর অর্থ ‘জানা’। এই ধাতু হতে বেদ শব্দের উৎপত্তি হওয়াই‘বেদ’ শব্দের মূল অর্থ ‘জ্ঞান’। বেদ বিশেষতঃ ঈশ্বর, জীব ও জগৎ সম্বন্ধে পারমার্থিক জ্ঞানই বুঝায়। সৃষ্টিও যেমন অনাদি ও অনন্ত, ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞানও তেমনই অনাদি অনন্ত। ঈশ্বর সম্বন্ধে এই শাশ্বত ও অফুরন্ত জ্ঞানরাশিই বেদ শব্দের মুখ্য অর্থ। বেদ সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ।বেদ যেসকল নামে পরিচিত **************************

পুরনো বৈদিক সংহিতা

হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, বেদ 'ব্রহ্ম' বা সর্বোচ্চ উপাস্য ঈশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত। চারটি প্রধান সংকলনকে কেন্দ্র করে লিপিবদ্ধ হয়েছে বেদ। বেদের বানী গুলি বহুযুগ ধরে মৌখিক আলোচনার মাধ্যমেই এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হত। ★অনেকেরই বিশ্বাস বেদ মনুষ্য রচিত কোন গ্রন্থ নয় তাই এটিকে 'অপৌরুষেয়' বলা হয়। ★মনে করা হয় এটি স্বয়ং ঈশ্বরের বানী তাই এর অপর নাম 'নিত্য'। ★বৈদিক যুগের শুরুতে লেখার প্রচলন না থাকায় প্রাচীন ভারতীয় ঋষি-মুনিরা শুনে শুনে বেদের বানী মনে রাখতেন  তাই বেদের অন্য নাম 'শ্রুতি' অর্থাৎ যা শোনা হয়েছে।

পুরনো বৈদিক সংহিতা
পুরনো বৈদিক সংহিতা

★বেদের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলিকে বলা হয় 'স্মৃতি' অর্থাৎ যা মনে রাখা হয়েছে।

★ বৈদিক ধর্মগ্রন্থগুলি একত্রে 'শ্রুতি সংহিতা' নামে পরিচিত।

★ বেদ ‘আগম’ নামে পরিচিত।‘আগম’ শব্দের অর্থ ‘যা ঐতিহ্য রূপে আমাদের কাছে এসেছে’। ★ বেদ নিগম নামেও পরিচিত। ‘নিগম’ শব্দের অর্থ হল ‘যা জীবনের মূল সমস্যাগুলির স্পষ্ট ও নিশ্চিত সমাধান নির্দেশ করে’। বেদ সম্পর্কিত ধর্মবিশ্বাস :- *********************** বেদের প্রতিটি পদ মন্ত্র নামে পরিচিত। কোনো কোনো বৈদিক মন্ত্র আধুনিক কালে প্রার্থনা সভা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়ে থাকে। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা ও বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায় বেদ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা বেদকে তাদের প্রধান ধর্মমত হিসেবে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য শাখা, বিশেষত বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম বেদকে তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে না। অধিকন্তু বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম,শিখধর্ম, ও ব্রাহ্মধর্ম, এবং দক্ষিণ ভারতের অনেক অব্রাহ্মণ হিন্দুরা বেদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে না। কোনো কোনো দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ তামিলদিব্য প্রবন্ধম্‌ বাআলোয়ারদের রচনাকে বেদের সমতুল্য জ্ঞান করেন।

বেদের বিভিন্ন বিভাগ :-

******************** বেদ চারটি।

যথা–(১) ঋগ্বেদ,

(২) সামবেদ,

(৩) যজুর্বেদ ও

(৪)অথর্ববেদ।

ঋগ্বেদ :- ********

★ঋগ্বেদে ভারত তথা দুনিয়ার প্রাচীনতম লিখিত গ্রন্থ। ★ গ্রন্থটি মূলত ১০টি পুস্তক এ বিভক্ত।

★ এটিতে ১,০২৮ টি সংস্কৃত সূক্ত বা শ্লোকের সংকলন রয়েছে।

★ এটিতে হোতা বা প্রধান পুরোহিত কর্তৃক পাঠিত ১০, ৫৫২টি 'ঋক' বা মন্ত্রের সংকলন রয়েছে।

★ ঈশ্বর, দেবতা ও প্রকৃতি বিষয়ক আলোচনা ঋগবেদে প্রাধান্য পেয়েছে।

★ সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে বড়ো বৈদিক গ্রন্থ।

★ হিন্দুধর্মের বিখ্যাত গায়ত্রী মন্ত্র এরই অংশ।

★ তৎকালীন নারীশিক্ষা তথা সমাজের একটি পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়।

সামবেদ :- *********

★ ঋগ্বেদ-এর বাছাই করা কয়েকটি সূক্তে সুরারোপ করে কয়েকটি যজ্ঞের বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে গান করার নির্দেশ দেওয়া আছে।

★ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আদি উৎস হল এই সামবেদ। ★ উদ্গাতার বা মন্ত্রপাঠক পুরোহিত কর্তৃক গীত স্তোত্রগুলি সংকলিত হয়েছে। যজুর্বেদ :- *********

★ এটিতে মূলত যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন বর্নিত আছে।

★ অধ্বর‍্যু বা অনুষ্ঠাতা পুরোহিত কর্তৃক পঠিত মন্ত্রের সংকলন রয়েছে।

অথর্ববেদ :- ***********

★ পরবর্তী বৈদিক যুগে এটি রচিত হয়েছে।

★ নীতিতত্ত্ব ও আয়ুর্বেদ তত্ব বর্নিত আছে।

★ তৎকালীন চিকিৎসাবিদ্যার একটি বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।&n;

★ মারণ, উচাটন, বশীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রগুলি সংকলিত হয়েছে।

এই চারটি বেদের প্রতিটি আবার চারটি করে অংশে বিভক্ত। এগুলি হল–

(১) সংহিতা বা মন্ত্রভাগ,

(২) ব্রাহ্মণ,

(৩) আরণ্যক ও

(৪) উপনিষদ্‌।

★ ‘সংহিতা’ অংশে লিপিবদ্ধ হয়েছে ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, বিষ্ণু, রুদ্র প্রমুখ বৈদিক দেবতার বিভিন্ন মন্ত্র ও স্তবস্তুতি। বেদমন্ত্রগুলি প্রধানত পদ্যে রচিত, কেবল যজুঃসংহিতার কিছু অংশ গদ্যে রচিত। এটাই বেদের প্রধান অংশ। এতে আছে দেবস্তুতি, প্রার্থনা ইত্যাদি। ঋক্‌ মন্ত্রের দ্বারা যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বান করা হয়, যজুর্মন্ত্রের দ্বারা তাঁদের উদ্দেশে আহুতি প্রদান করা হয় এবং সামমন্ত্রের দ্বারা তাঁদের স্তুতি করা হয়।

★ ‘ব্রাহ্মণ’ অংশে রয়েছে বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা ও যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন। কোন যজ্ঞে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করা দরকার, তা জানা যায় ব্রাহ্মণ অংশ থেকে। এটি গদ্যে রচিত এবং প্রধানত কর্মাশ্রয়ী। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে, ব্রাহ্মণ জাতির সঙ্গে এই গ্রন্থের কোনো সম্পর্ক নেই।

★ ‘আরণ্যক’ অংশে রয়েছে বনবাসী তপস্বীদের যজ্ঞভিত্তিক বিভিন্ন ধ্যানের বর্ণনা। এটি কর্ম ও জ্ঞান উভয়াশ্রয়ী।

★ ‘উপনিষদ্‌’ বা বেদান্ত সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানাশ্রয়ী। অংশটিতে পরম সত্যের এক মর্মিয় ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। পরম সত্যকে উপলব্ধি করার শ্রেষ্ঠ পন্থাটিও উপনিষদ্‌ই আমাদের শিক্ষা দেয়। স্বামী হর্ষানন্দের ভাষায়, “উপনিষদ্‌গুলি হলো দার্শনিক নিবন্ধ। এদের উপজীব্য ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালবর্তী সত্যবস্তু’, ‘মানুষের প্রকৃত স্বরূপ’, ‘জীবনের উদ্দেশ্য ও সেই উদ্দেশ্যসাধনের উপায়’ প্রভৃতি বিষয়।”বেদের বিষয়বস্তু সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড।

★ কর্মকাণ্ডে আছে বিভিন্ন দেবদেবী ও যাগযজ্ঞের বর্ণনা। কোন দেবতার যজ্ঞ কখন কিভাবে করণীয়, কোন দেবতার কাছে কি কাম্য, কোন যজ্ঞের কি ফল ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের আলোচ্য বিষয়।

★ জ্ঞানকাণ্ডে আছে ব্রহ্মের কথা। ব্রহ্মের স্বরূপ কি, জগতের সৃষ্টি কিভাবে, ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক কি এসব আলোচিত হয়েছে জ্ঞানকাণ্ডে। জ্ঞানকাণ্ডই বেদের সারাংশ। এখানে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এক, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, তাঁরই বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন দেবতা। জ্ঞানকাণ্ডের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শনচিন্তার চরম রূপ উপনিষদের বিকাশ ঘটেছে।

উপসংহার :- ********** বেদে সামাজিক বিধিবিধান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদির কথাও আছে। এমনকি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথাও আছে। বেদের এই সামাজিক বিধান অনুযায়ী সনাতন হিন্দু সমাজ ও হিন্দুধর্ম রূপ লাভ করেছে। হিন্দুদের বিবাহ, অন্তেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনও বৈদিক রীতিনীতি যথাসম্ভব অনুসরণ করা হয়। এসব কারণে বেদকে শুধু ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই নয়, প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও ইতিহাসের একটি দলিল হিসেবেও গণ্য করা হয়।

Next Post Previous Post
1 Comments
  • নামহীন
    নামহীন ৭ এপ্রিল, ২০২২ এ ১০:০৪ PM

    Nice

Add Comment
comment url