সবচেয়ে পুরনো বৈদিক সংহিতা কোনটি
হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, বেদ 'ব্রহ্ম' বা সর্বোচ্চ উপাস্য ঈশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত। চারটি প্রধান সংকলনকে কেন্দ্র করে লিপিবদ্ধ হয়েছে বেদ। বেদের বানী গুলি বহুযুগ ধরে মৌখিক আলোচনার মাধ্যমেই এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হত। ★অনেকেরই বিশ্বাস বেদ মনুষ্য রচিত কোন গ্রন্থ নয় তাই এটিকে 'অপৌরুষেয়' বলা হয়। ★মনে করা হয় এটি স্বয়ং ঈশ্বরের বানী তাই এর অপর নাম 'নিত্য'। ★বৈদিক যুগের শুরুতে লেখার প্রচলন না থাকায় প্রাচীন ভারতীয় ঋষি-মুনিরা শুনে শুনে বেদের বানী মনে রাখতেন তাই বেদের অন্য নাম 'শ্রুতি' অর্থাৎ যা শোনা হয়েছে।
পুরনো বৈদিক সংহিতা |
★বেদের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলিকে বলা হয় 'স্মৃতি' অর্থাৎ যা মনে রাখা হয়েছে।
★ বৈদিক ধর্মগ্রন্থগুলি একত্রে 'শ্রুতি সংহিতা' নামে পরিচিত।
বেদের বিভিন্ন বিভাগ :-
******************** বেদ চারটি।
যথা–(১) ঋগ্বেদ,
(২) সামবেদ,
(৩) যজুর্বেদ ও
(৪)অথর্ববেদ।
ঋগ্বেদ :- ********
★ঋগ্বেদে ভারত তথা দুনিয়ার প্রাচীনতম লিখিত গ্রন্থ। ★ গ্রন্থটি মূলত ১০টি পুস্তক এ বিভক্ত।
★ এটিতে ১,০২৮ টি সংস্কৃত সূক্ত বা শ্লোকের সংকলন রয়েছে।
★ এটিতে হোতা বা প্রধান পুরোহিত কর্তৃক পাঠিত ১০, ৫৫২টি 'ঋক' বা মন্ত্রের সংকলন রয়েছে।
★ ঈশ্বর, দেবতা ও প্রকৃতি বিষয়ক আলোচনা ঋগবেদে প্রাধান্য পেয়েছে।
★ হিন্দুধর্মের বিখ্যাত গায়ত্রী মন্ত্র এরই অংশ।
★ তৎকালীন নারীশিক্ষা তথা সমাজের একটি পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়।
সামবেদ :- *********
★ ঋগ্বেদ-এর বাছাই করা কয়েকটি সূক্তে সুরারোপ করে কয়েকটি যজ্ঞের বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে গান করার নির্দেশ দেওয়া আছে।
★ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আদি উৎস হল এই সামবেদ। ★ উদ্গাতার বা মন্ত্রপাঠক পুরোহিত কর্তৃক গীত স্তোত্রগুলি সংকলিত হয়েছে। যজুর্বেদ :- *********
★ এটিতে মূলত যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন বর্নিত আছে।
★ অধ্বর্যু বা অনুষ্ঠাতা পুরোহিত কর্তৃক পঠিত মন্ত্রের সংকলন রয়েছে।
অথর্ববেদ :- ***********
★ পরবর্তী বৈদিক যুগে এটি রচিত হয়েছে।
★ নীতিতত্ত্ব ও আয়ুর্বেদ তত্ব বর্নিত আছে।
★ তৎকালীন চিকিৎসাবিদ্যার একটি বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।&n;
★ মারণ, উচাটন, বশীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রগুলি সংকলিত হয়েছে।
এই চারটি বেদের প্রতিটি আবার চারটি করে অংশে বিভক্ত। এগুলি হল–
(১) সংহিতা বা মন্ত্রভাগ,
(২) ব্রাহ্মণ,
(৩) আরণ্যক ও
(৪) উপনিষদ্।
★ ‘ব্রাহ্মণ’ অংশে রয়েছে বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা ও যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন। কোন যজ্ঞে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করা দরকার, তা জানা যায় ব্রাহ্মণ অংশ থেকে। এটি গদ্যে রচিত এবং প্রধানত কর্মাশ্রয়ী। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে, ব্রাহ্মণ জাতির সঙ্গে এই গ্রন্থের কোনো সম্পর্ক নেই।
★ ‘আরণ্যক’ অংশে রয়েছে বনবাসী তপস্বীদের যজ্ঞভিত্তিক বিভিন্ন ধ্যানের বর্ণনা। এটি কর্ম ও জ্ঞান উভয়াশ্রয়ী।
★ ‘উপনিষদ্’ বা বেদান্ত সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানাশ্রয়ী। অংশটিতে পরম সত্যের এক মর্মিয় ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। পরম সত্যকে উপলব্ধি করার শ্রেষ্ঠ পন্থাটিও উপনিষদ্ই আমাদের শিক্ষা দেয়। স্বামী হর্ষানন্দের ভাষায়, “উপনিষদ্গুলি হলো দার্শনিক নিবন্ধ। এদের উপজীব্য ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালবর্তী সত্যবস্তু’, ‘মানুষের প্রকৃত স্বরূপ’, ‘জীবনের উদ্দেশ্য ও সেই উদ্দেশ্যসাধনের উপায়’ প্রভৃতি বিষয়।”বেদের বিষয়বস্তু সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড।
★ কর্মকাণ্ডে আছে বিভিন্ন দেবদেবী ও যাগযজ্ঞের বর্ণনা। কোন দেবতার যজ্ঞ কখন কিভাবে করণীয়, কোন দেবতার কাছে কি কাম্য, কোন যজ্ঞের কি ফল ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের আলোচ্য বিষয়।
★ জ্ঞানকাণ্ডে আছে ব্রহ্মের কথা। ব্রহ্মের স্বরূপ কি, জগতের সৃষ্টি কিভাবে, ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক কি এসব আলোচিত হয়েছে জ্ঞানকাণ্ডে। জ্ঞানকাণ্ডই বেদের সারাংশ। এখানে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এক, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, তাঁরই বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন দেবতা। জ্ঞানকাণ্ডের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শনচিন্তার চরম রূপ উপনিষদের বিকাশ ঘটেছে।
উপসংহার :- ********** বেদে সামাজিক বিধিবিধান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদির কথাও আছে। এমনকি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথাও আছে। বেদের এই সামাজিক বিধান অনুযায়ী সনাতন হিন্দু সমাজ ও হিন্দুধর্ম রূপ লাভ করেছে। হিন্দুদের বিবাহ, অন্তেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনও বৈদিক রীতিনীতি যথাসম্ভব অনুসরণ করা হয়। এসব কারণে বেদকে শুধু ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই নয়, প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও ইতিহাসের একটি দলিল হিসেবেও গণ্য করা হয়।
Nice