শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

 শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুঃ শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর আবির্ভাব নবদ্বীপের পবিত্র ভুমিতে ১৪৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। বাংলা ফাল্গুন মাস। বসন্ত কাল। দেশ তখন মুসলিম শাসনের অধীন। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আবির্ভাব হুগলী জেলার পুণ্যভূমি কামারপুকুরে ১৮৩৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। বাংলা ফাল্গুন মাস আর বসন্ত কাল। তখন ভারতভূমি ইংরেজ শাসনে।শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর সাধনভূমি নবদ্বীপ ছিল গঙ্গাতীরে আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সাধনভূমি দক্ষিণেশ্বর গঙ্গা তীরেই। 

শাস্ত্রমতে, উভয় সাধনভূমির ভূমিভাগ ছিল কূর্ম পৃষ্ঠাকৃতির এবং রম্য পুষ্পশোভিত।শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর পিতা ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পিতাও ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। উভয়ের পূর্বপুরুষরা নিজেদের ভিটা ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র গমন করে সেখানেই আবাসভূমি গড়ে তোলেন।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর সময় অ-হিন্দুদের আক্রমণে এবং তাদের প্রচেষ্টায় শত শত লোক হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছিল। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সময় দলে দলে শিক্ষিত যুবকরা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীস্টান হয়েছিল।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছবি
শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর আদিনাম বিশ্বম্ভর আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আদিনাম গদাধর। উভয় নামই সমার্থক আর উভয় নামেই শ্রীনারায়ণকে বুঝায়।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দুজনেই বাল্যকালে ঈশ্বরীয় ভাবে আবিষ্ট থাকতেন। শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু ছোটবেলা থেকেই ভাবাবিষ্ট হয়ে নানাবিধ উপদেশ দিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবেরও তাই হত।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু এবং শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব উভয়ের জন্ম দৈবীভাবে। উভয়ের পিতা দৈবী স্বপ্ন দেখেছেন --
শাস্ত্রে আছে --
জগন্নাথ কহে, - আমি স্বপন দেখিল।
জ্যোতির্ময় ধাম মোর হৃদয়ে পশিল॥
আমার হৃদয় হতে তোমার হৃদয়।
হেন বুঝি জন্মিবেন কোন মহাশয়॥ (চৈতন্য চরিতামৃত)।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবঃ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পিতা ক্ষুদিরাম গয়ায় গিয়ে দিব্য স্বপ্ন দেখেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মের আগে থেকেই তাঁর জন্মের নানা অলৌকিক পূর্বাভাস তাঁর পিতামাতা পেয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পিতা ক্ষুদিরাম তীর্থ ভ্রমণার্থে গয়া গমন করেন। সেখানে এক রাত্রে ঘুমের মধ্যে তাঁর স্বপ্নে আবির্ভূত হন বিষ্ণু-অবতার গদাধর। স্বপ্নেই গদাধর বলেন যে, তিনি ক্ষু‌দিরামের সন্তান রূপে অবতীর্ণ হবেন ধরাধামে। এই ঘটনার এক বছর পরে জন্ম হয় শ্রীরামকৃষ্ণের। আবার ক্ষুদিরাম যখন গয়ায় তখন রামকৃষ্ণের জননী চন্দ্রাদেবী একদিন শিব মন্দিরে গিয়েছিলেন পূজা দিতে। সেখানে এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। তিনি প্রত্যক্ষ করেন, এক দিব্যজ্যোতি মহাদেবের শ্রীঅঙ্গ থেকে নির্গত হয়ে প্রবেশ করছে তাঁর শরী‌রে। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই গর্ভবতী হন চন্দ্রা দেবী। এই কথা শুনে ক্ষুদিরাম বলতেন --

এ অতি মঙ্গল কথা না করিবা ভয়।
হইবে গোকুলচাঁদ ভুবনে উদয়॥ (রামকৃষ্ণ পুঁথি)।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর জন্ম পিতা মাতার শোণিত ধাতু থেকে নয়। বৈষ্ণবরা বলেন -- মহাপ্রভু প্রাকৃত মানুষ নহে, অযোনিসম্ভব। আবার, রামকৃষ্ণ পুঁথিতে আছে --

কখনও বলেন তিনি হৃদি অকপটে।
পতি স্পর্শে গর্ভ নয়, কি ঢুকেছে পেটে॥

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর আবির্ভাব লগ্নটি সূচিত হয়েছিল বিদ্যাপতি -চণ্ডীদাসের পদাবলী মাধুর্যে। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ক্ষেত্রে হয়েছিল রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের প্রাণজাগানিয়া মাতৃসঙ্গীতে। এই দুই অবতারের প্রভায় প্রমাণিত হল -- সংস্কৃতির জন্ম হয় ধর্মের অন্তরলোকে।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু বাল্যকালে এক ভক্তের ইষ্টদেবতার ভোগ গ্রহণ করে বলেছিলেন -- ওগো চেয়ে দেখ না, আমি খাচ্ছি। এই থেকে ঐ ভক্ত বুঝতে পারে বালক নিমাই স্বয়ং তাঁর ইষ্টদেবতা। অপরদিকে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও পিতা ক্ষুদিরামের ইষ্টদেবতা রামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগ গ্রহণ করেছিলেন। রামকৃষ্ণ পুঁথিতে আছে --

আমি সেই রঘুবীর দেখনা গো চেয়ে।
কেমন সেজেছি মালা চন্দন পরিয়ে॥

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু ছিলেন অজানুবাহুলম্বিত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও ছিলেন অজানুবাহুলম্বিত।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর দীক্ষাগুরু ছিলেন ঈশ্বরপুরী আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সন্ন্যাস দীক্ষা হয় তোতাপুরীর নিকট। উভয় অবতার পুরুষ ছিলেন পুরী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত শিষ্য।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর মাঝে জ্ঞান আর ভক্তি দুই ছিল। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ছিলেন সমন্বয় সাধক। জ্ঞান আর ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় করেছেন এই অবতার।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই দুই অবতারের মাতৃভক্তি ছিল অসাধারণ। শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু তাঁর জননীকে সাক্ষাৎ ভগবতীরূপে প্রণাম করতেন। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও নিজ জননীকে ফুল চন্দন দিয়ে প্রণাম করতেন দেবীভাবে।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু ভক্তদের শিবরূপে দর্শন দিয়েছিলেন (চৈতন্য ভাগবত, মধ্যখণ্ড, ৮ম অধ্যায়)। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মথুরবাবুকে শিবরূপে দর্শন দিয়েছিলেন। আবার ছোট বেলায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব গাঁয়ের লোকদের শিবরূপে দর্শন দিয়েছিলেন। পুঁথিতে আছে --

দর্শকেরা দেখে তাঁরে নহে গদাধর।
আগত কৈলাস ছাড়ি কৈলাস ঈশ্বর॥
জ্ঞানহারা দর্শকেরা দেখিয়া মূরতি।
শিশু গদাধর অঙ্গে মহেশ প্রকৃতি॥

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু নিজের স্বীয় পত্নীকে নিজেই দৈবী ভাবে চিহ্নিত করেছেন। শাস্ত্রে বলা আছে --

দৈবে লক্ষ্মী একদিন গেলা গঙ্গাস্নানে।
গৌরচন্দ্র হেনই সময়ে সেই স্থানে॥
নিজ লক্ষ্মী চিনিয়া হাসিলা গৌরচন্দ্র।
লক্ষ্মীও বন্দিলা মনে প্রভু পদদ্বন্দ্ব।
হেন মতে দোঁহা চিনি দোঁহা ঘরে গেলা॥ (চৈতন্য ভাগবত)।

আবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বিয়ে দেবেন বলে মনস্থ করেছেন মা চন্দ্রাদেবী আর দাদা রামেশ্বর। কিন্তু পছন্দমতো পাত্রী আর পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে ভাবাবিষ্ট ঠাকুরই একদিন বলে দিলেন, ‘‘জয়রামবাটী গ্রামের শ্রীরামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে যে পঞ্চম বর্ষীয়া কন্যা, সেই আমার উপযুক্ত।’’ ঠাকুরের নির্দেশিত বাড়িতে খোঁজ করতেই সন্ধান মিলল সারদামণির।

মধুরভাব সাধনকালে শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু জগন্নাথদেবকে কোলে নিতে অগ্রসর হয়েছিল। বর্ণনায় আছে --
ইচ্ছা হইল জগন্নাথ কোলে করিবার। (চৈতন্য ভাগবত, অন্তখণ্ড)।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও মধুরভাবে সাধনার সময় জগন্নাথকে আলিঙ্গন করেছেন। (রামকৃষ্ণ কথামৃত, ৪/২৩/৭)।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু রাধাভাবে বিভোর হয়ে বিলাপ করতেন --
কাঁহা মোর প্রাণনাথ মুরলীবদন॥ (চৈতন্য চরিতামৃত)।

অপরদিকে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যখন রাধাভাবে সাধন করেছেন তখন তাঁর এরূপ বিরহ হত -- শ্রীকৃষ্ণ বিরহের প্রবল প্রভাবে এইকালে শরীরের লোমকূপ দিয়ে সময়ে সময়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত বার হত, দেহের গ্রন্থি সকল ভগ্নপ্রায় শিথিল বলে দেখা দিত, দেহ কখনও মৃতের মত সংজ্ঞাশূন্য হয়ে পরে থাকতো। (রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ)।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু বলেছেন --

নীচজাতি নহে ভজনে অযোগ্য।
আবার ,
যেই ভজে সেই বড় অভক্ত হীন ছার।
কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতিকুলাদি বিচার॥ (চৈতন্য চরিতামৃত)।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন --

কেবল এক উপায়ে জাতিভেদ উঠতে পারে। সেটি ভক্তি। ভক্তের জাত নেই। চণ্ডালের ভক্তি হলে আর চণ্ডাল থাকেনা। (রামকৃষ্ণ কথামৃত ৫।২।৪)।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর দুই প্রকার ভক্ত ছিল। পার্ষদগণ আর সাধকগণ। চৈতন্য চরিতামৃতে আছে --
সেই ভক্তগণ হয় দ্বিবিধ প্রকার।
পারিষদগণ এক, সাধকগণ আর॥

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবেরও দুই প্রকার ভক্ত ছিল। অন্তরঙ্গ অর্থাৎ পারিষদ যেমন -- স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী সারদানন্দ সহ ১৭ জন। আর সাধক ভক্ত অনেক।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর দুই ভাব ছিল। ভক্ত ভাব আর ভগবান ভাব। নিজেই ধর্ম পালন করে জীবকে শিক্ষা দিয়েছেন।

আপনে করিমু ভক্ত ভাব অঙ্গীকারে।
আপনি আচরি ভক্তি শিখাইমু সভারে॥
আপনে না কৈলে ধর্ম শিখান না যায়।
এইতো সিদ্ধান্ত গীতা ভাগবতে গায়॥ (চৈতন্য চরিতামৃত)।

ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেবের ক্ষেত্রেও এই দুইভাব ছিল। কথামৃতে আছে --

ঠাকুরকে জগন্মাতা বলিয়াছিলেন, “তুই আর আমি এক। তুই ভক্তি নিয়ে থাক -- জীবের মঙ্গলের জন্য। ভক্তেরা সকলে আসবে। তোর তখন কেবল বিষয়ীদের দেখতে হবে না; অনেক শুদ্ধ কামনাশূন্য ভক্ত আছে, তারা আসবে।” ঠাকুরবাড়িতে আরতির সময় যখন কাঁসরঘন্টা বাজিত, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ কুঠিতে গিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতেন, “ওরে ভক্তেরা, তোরা কে কোথায় আছিস, শীঘ্র আয়।” ( কথামৃত অখণ্ড, ৪)।

স্বয়ং অবতারি অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে যখন ভগবান আবির্ভূত হন তখন অন্য অবতার ও ঈশ্বরীয় রূপ সেই অবতারে মিলে যায়। শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর মাঝে ভক্তরা অনেক ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন করেন।

পূর্ণ ভগবান অবতরে যেই কালে।
আর সব অবতার তাঁতে আসি মিলে॥ (চৈতন্য চরিতামৃত)।

আবার, শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু নিজেই বলেছেন --

আমিই কৃষ্ণ, আমিই রাম, আমিই নারায়ণ। (চৈতন্য ভাগবত)।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজেই নিজের স্বরূপ সম্পর্কে বলছেন এইভাবে --

“অনেক ঈশ্বরীয় রূপ দেখেছি! তার মধ্যে এই রূপটিও (নিজের মূর্তি) দেখছি !”

আবার --

হঠাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গম্ভীর হইলেন, যেন কি গুহ্যকথা বলিবেন। ভক্তদের বলিতেছেন, “এখানে বাহিরের লোক কেউ নাই, তোমাদের একটা গুহ্যকথা বলছি। সেদিন দেখলাম, আমার ভিতর থেকে সচ্চিদানন্দ বাইরে এসে রূপ ধারণ করে বললে, আমিই যুগে যুগে অবতার। দেখলাম পূর্ণ আর্বিভাব, তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।”

আবার --

কাশীপুর উদ্যানে ঠাকুর যখন ক্যানসার রোগে যন্ত্রণায় অস্থির হইয়াছেন, ভাতের তরল মণ্ড পর্যন্ত গলাধঃকরণ হইতেছে না, তখন একদিন নরেন্দ্র ঠাকুরের নিকট বসিয়া ভাবিতেছেন, এই যন্ত্রণামধ্যে যদি বলেন যে, আমি সেই ঈশ্বরের অবতার তাহলে বিশ্বাস হয়। চকিতের মধ্যে ঠাকুর বলিতেছেন -- “যে রাম যে কৃষ্ণ, ইদানিং সে-ই রামকৃষ্ণরূপে ভক্তের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।” নরেন্দ্র এই কথা শুনিয়া অবাক্‌ হইয়া রহিলেন। ঠাকুর স্বধামে গমন করিলে পর নরেন্দ্র সন্ন্যাসী হইয়া অনেক সাধন-ভজন-তপস্যা করিলেন। তযন তাঁহার হৃদয়মধ্যে অবতার সম্বন্ধে ঠাকুরের মহাবাক্য সকল যেন আরও প্রস্ফুটিত হইল। তিনি স্বদেশে-বিদেশে এই তত্ত্ব আরও পরিষ্কাররূপে বুঝাইতে লাগিলেন। (রামকৃষ্ণ কথামৃত)।

ঠাকুর এখানে নিজেই বলছেন -- "আমিই যুগে যুগে অবতার। দেখলাম পূর্ণ আর্বিভাব, তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।” আবার , স্বয়ং বিবেকানন্দকে বলছেন --“যে রাম যে কৃষ্ণ, ইদানিং সে-ই রামকৃষ্ণরূপে ভক্তের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।”

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু নিজেই বলেছেন তিনি আবার নিত্যানন্দের দেহকে কেন্দ্র করে অবতাররূপে আসবেন। একথা শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে --

এই মত আছে আরও দুই অবতার।
কীর্তন আনন্দরূপ হইবে আমার॥ (চৈতন্য ভাগবত)।

আবার,

আর দুই জন্ম এই সংকীর্তন আরম্ভে।
হইব তোমার পুত্র আমি অবিলম্বে। (চৈতন্য ভাগবত)।

আবার অদ্বৈত আচার্যের গলা ধরে বললেন --

অদ্বৈতের গলা ধরি কহেন বার বার।
পুনঃ যে করিব লীলা মোর চমৎকার॥ (চৈতন্য ভাগবত)।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যে মহাপ্রভুর পরের অবতার সে কথা শাস্ত্র মধ্যে লেখা আছে --

একদিন সমাসীন প্রভুর গোচরে।
অনুরাগে ভক্তিগ্রন্থ পড়ে ভক্তিভরে॥
যথা অষ্টসাত্ত্বিক ভাবের বিবরণ।
নানাবিধ অশ্রু আদি পুলক কম্পন॥
যবে যে ভাবের কথা পড়েন ব্রাহ্মণী।
প্রভুর শ্রীঅঙ্গে তাহা উদয় তখনি॥
পড়ে গ্রন্থ আর প্রভু অঙ্গপানে চায়।
বর্ণিত প্রত্যক্ষ দুয়ে একত্র মিশায়॥
করতালি দিয়ে মাগী নেচে নেচে বলে।
এইতো গৌরাঙ্গদেব নিতাইয়ের খোলে॥ (রামকৃষ্ণ পুঁথি)।

স্বামী বিবেকানন্দকে ঠাকুর নিজেই বলেছেন – নদের গৌরাঙ্গের নাম শুনিস নি ? আমি সেই নদের গৌর॥

বিবেকানন্দ নিজেই বলেছেন – ঠাকুর আমাদের অনেকবার বলেছেন – তিনিই একাধারে চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত॥ (রামকৃষ্ণ কথামৃত)।

তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত ও বৈষ্ণব আচার্য চূড়ামণি ভগবানদাস বাবাজী বলেছেন -- আপনিই চৈতন্য মহাপ্রভু। কলু টোলার চৈতন্যের আসনে একমাত্র আপনিই বসার অধিকারী।

চৈতন্য চরিতামৃতে উল্লেখ আছে, অদ্বৈত মহাপ্রভুর হুঙ্কারে নদীয়ায় গৌর আবির্ভূত হয়েছে --

যাঁহার তুলসীজলে যাঁহার হুঙ্কারে।
স্বগণ সহিতে চৈতন্যের অবতারে॥ (চৈতন্য চরিতামৃত, আদিলীলা)।

আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজেই বলছেন --

কথায় বলে অদ্বৈতের হুঙ্কারেই গৌর নদীয়ায় আসিয়াছিলেন, সেইরূপ ওঁর (নরেন্দ্রের) জন্যই তো সব গো। (দিব্যভাব ও নরেন্দ্রনাথ, ১২/৩৩০)।

অবতারের আকর্ষণ শক্তি প্রবল। আকর্ষণ করে বলেই তিনি কৃষ্ণ। নিত্যানন্দ প্রভু ব্রজধামে গিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণকে পাবার আশায়। সেখানে না পেয়ে তিনি ভক্তের মাধ্যমে জানতে পারেন -- কৃষ্ণ এখন গৌড়দেশে। গৌরহরির আকর্ষণে নিত্যানন্দ চলে আসেন নদীয়ায়।
অপরদিকে, বিবেকানন্দের মত বিশ্বজয়ী সন্ন্যাসী রামকৃষ্ণের প্রবল আকর্ষণে নরেন্দ্রনাথ থেকে হয়েছেন বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ।

বাসুদেব সার্বভৌম বিরাট পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু তিনি মহাপ্রভুকে চিনতে পারেন নাই। প্রথমে মহাপ্রভুকে অবতার বলে স্বীকার করেন নাই। কিন্তু মহাপ্রভুর কৃপায় তিনিও পরে মহাপ্রভুকে অবতাররূপে স্বীকার করেন। আবার, অপরদিকে কলুটোলার পরমবৈষ্ণব আচার্য চূড়ামণি ভগবানদাস বাবাজীও ঠাকুর রামকৃষ্ণকে চিনতে পারেন নি। তাঁর মনে প্রবল অহংকার ছিল। অবশেষে ঠাকুর তাঁর অহংকার নাশ করেন। পরবর্তীতে সেই বৈষ্ণব চূড়ামণি পণ্ডিত ঠাকুর কে সাক্ষাৎ চৈতন্য মহাপ্রভু হিসেবে প্রচার করেন।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু স্বয়ং ভক্তদের জগত জননী দুর্গারূপে দর্শন দান করেন।

---- দুর্গারূপী গৌরহরি স্তব ----

জননী আবেশ বুজিলেন সর্বজনে।
সেইরূপে সভে স্তুতি পড়ে, প্রভু শুনে॥
জয় জয় জগত জননী, মহামায়া
দুঃখিত জীবেরে দেহ চরণের ছায়া॥
জয় জয় অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড কোটীশ্বরী
তুমি যুগে যুগে ধর্ম রাখ অবতরি॥
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবে তোমার মহিমা
বলিতে না পারে অন্যে কে দিবেক সীমা॥
জগত স্বরূপা তুমি, তুমি সর্ব শক্তি
তুমি শ্রদ্ধা, দয়া, লজ্জা, তুমি বিষ্ণু ভক্তি॥
যত বিদ্যা সকল তোমার মূর্তি ভেদ
সর্ব প্রকৃতির শক্তি তুমি কহে বেদ॥
নিখিল ব্রহ্মাণ্ড গনের সর্ব মাতা
কে তোমার স্বরূপ কহিতে পারে কথা॥
তুমি ত্রিজগৎ হেতু গুনত্রয়ময়ি
ব্রম্মাদি তোমারে নাহি জানে, এই কহি॥
সব্বাশ্রয়া তুমি সর্ব জীবের বসতি
তুমি আদ্যা অবিকারা পরমা প্রকৃতি॥
জগত জননী তুমি দ্বিতীয়া রহিতা
মহী রুপে তুমি সর্ব জীব পাল মাতা॥
জল রুপে তুমি সর্ব জীবের জীবন
তোমা স্মরিলে খণ্ডে অশেষ বন্ধন॥
সাধুজন গৃহে তুমি লক্ষ্মী মূর্তিমতী
অসাধুর ঘরে তুমি কালরুপাকৃতি॥
তুমি সে করাহ ত্রিজগতে সৃষ্টি স্থিতি
তোমা না ভজিলে পায় ত্রিবিধ দুর্গতি॥
তুমি শ্রদ্ধা বৈষ্ণবের সর্বত্র উদয়া
রাখহ জননী দিয়া চরণের ছায়া॥
তোমার মায়ায় মগ্ন সকল সংসার
তুমি না রাখিলে মাতা কে রাখিবে আর॥
সবার উদ্ধার লাগি তোমার প্রকাশ
দুঃখিত জীবের মাতা কর নিজ দাস॥
ব্রহ্মাদির বন্দ্য তুমি সর্বভূত বুদ্ধি
তোমা স্মরিলে সর্ব মন্ত্রাদির শুদ্ধি॥
এইমত স্তুতি করে সকল মহান্ত
বর মুখ মহাপ্রভু শুনয়ে নিতান্ত॥ (চৈতন্য ভাগবত, ১৮ অধ্যায়)।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবও ভক্তদের দুর্গারূপে দর্শন দিয়েছেন। তিনিই দুর্গা একথা নিজ মুখে বলেছেন। স্বামী সারদানন্দ লিখেছেন --

একদিন ঠাকুর পঞ্চবটীতে বসিয়া আছেন। এমন সময় মা দুর্গা গঙ্গা বক্ষ হইতে উঠিয়া তাঁহার দিকে অগ্রসর হইলেন এবং নিকটে আসিয়া তাঁহার দেহে মিলাইয়া গেলেন। ঠাকুর পরে হৃদয়কে ডাকিয়া বলেছিলেন, মা দুর্গা এসেছিলেন। এই দেখ, মাটিতে তাঁর পদচিহ্ন রয়েছে। (রামকৃষ্ণ লীলামৃত, ১৪৬)। আবার, রামকৃষ্ণ পুঁথিতে আছে -- মথুর বাবু দুর্গা পূজার আয়োজন করেছেন। ঠাকুর পাশে বসে পূজা দেখছেন আর পূজারী মায়ের নৈবেদ্য নিবেদন করছেন। পুঁথিতে আছে এরকমভাবে --

যখন দুর্গায় ভোজ্য করে নিবেদন।
ব্রতীরূপে নিয়োজিত পূজক ব্রাহ্মণ॥
ভক্ষণ করেন প্রভু শ্রীহস্তে লইয়া।
দেখিয়া ব্রাহ্মণগণে উঠে চমকিয়া॥
অমনি মথুর কহে যতেক ব্রাহ্মণে।
বুঝিনু সম্পূর্ণ পূজা বাবার গ্রহণে॥
সার্থক হইল দুর্গাপূজা আরাধন।
নৈবেদ্য যখন বাবা করিলা গ্রহণ।।

শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত,শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব,শ্রীরামকৃষ্ণ,শ্রীরামকৃষ্ণের গান,#শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব,শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী,শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী,শ্রীরামকৃষ্ণ কথন,শ্রীরামকৃষ্ণের অমৃত কথা,শ্রীরামকৃষ্ণের,শ্রীরামকৃষ্ণের গল্প,শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কী সত্যিই মাছ খেতেন?,ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের,রামকৃষ্ণ পরমহংস,রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বাণী,রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনী,রামকৃষ্ণ পরমহংস জীবনী,শ্রী রামকৃষ্ণদেবের জীবনী,শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ,শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের জীবনী,চৈতন্য মহাপ্রভু,শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু,শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী,শ্রীচৈতন্যদেব,শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী,মহাপ্রভু,মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য,শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গান,শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন কাহিনী,চৈতন্য মহাপ্রভুকে কি হত্যা করা হয়েছিল,শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কি হয়েছিল,চৈতন্য মহাপ্রভুর মৃত্যু রহস্য সমাধান,মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য জীবনী,মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের বাণী।,শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাস কিভাবে নিয়েছিলেন।,শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী,মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের বদভ্যাস,
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>