সনাতন ধর্মে কি নারীর পুনর্বিবাহের অধিকার আছে এর স্বপক্ষে ব্যাখ্যা
সনাতন /হিন্দু নারী কেন একাধিক বিয়ে করতে পারে না আবার পুরুষ একাধিক বিবাহ করতে পারে এবং বিবাহ-বিচ্ছেদেরও অধিকার নেই কেন?সনাতন ধর্মে কি নারীর পুনর্বিবাহের অধিকার আছে? reli, সংক্ষেপে উত্তর হল অবশ্যই আছে তবে নিম্নে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে।
বিশ্বের আর কোন ধর্ম ও সমাজে পায় না যা সনাতন ধর্মে নারী যতটা স্বাধীনতা ও মর্যাদা পায় ।
সনাতনী নারী-পুরুষকে একসাথে পূজা করতে অনুমতি দেয়া হয়েছে এছাড়াও উল্লেখ আছে স্ত্রী ছাড়া স্বামীর কোন পূজা-যজ্ঞ সম্পন্ন হতে পারে না, তাই স্ত্রীকে সহধর্মিনী ও অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়।মন্দিরে নারী দেবী পূজিত হন এবং নারী পৌরহিত্য করতে পারেন। নারীর নেতৃত্ব সনাতন ধর্ম ও সমাজে স্বীকৃত। বিশ্বের অন্য কোন ধর্মের গ্রন্থ রচনাতে নারীর কোন অবদান স্বীকার করাই হয়নি। সনাতনী বিবাহ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট বিবাহ। সনাতনী বিবাহ হল একটা ব্রত, অবিচ্ছেদ্য, আজীবন সুখে-দু:খে একসাথে থাকার সংকল্প।
সনাতন ধর্মে কি নারীর পুনর্বিবাহ |
প্রথমে জেনে নিন নেই পবিত্র বেদ অনুযায়ী সনাতন ধর্ম নারীকে কতটুকু অধিকার দিয়েছে।
১/ নারী ও পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে পিতার সম্পত্তিতে । ঋগবেদ ৩/৩১/১
২/ সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক গর্ভের সে যেনো ভালো থাকে এটা গর্ভ অবস্থার নিয়ম পালন করতে হয় । অথর্ব বেদ ২/৩/২৩
৩/ কখনো যেনো কোনো সতীন না থাকে একজন নারীর । অথর্ব বেদ ৩/১৮/২
৪/মঙ্গলময়ী লক্ষী হল নারী । অথর্ব বেদ ৭/১/৬৪
৬/ শিশুর প্রথম জ্ঞানদাতা হল নারী । অথর্ব বেদ৭/৪৭/২
৭/ পতিগৃহে যাবে নারী শিক্ষা গ্রহণ শেষে । অথর্ববেদ ১১/৫/১৮,,
৮/ নারীর যেনো দুঃখ কষ্ট না হয়। অথর্ব বেদ১২/২/৩১
৯/ জ্ঞান উপহারদাও নারীকে উপহার হিসাবে । অথর্ববেদ ১৪/১/৬
১০/তাদের পরিত্যাগ কর যেসকল নারী দেহ রুপ দেখিয়ে অপরের সাথে বন্ধুত করতে চায়, তারা হায়েনাদের মত এবং তাদের জন্য নরকভোগ অনিবার্য, । ঋগবেদ ১০/৯৫/১৫
১১/ পরাশর সংহিতায় বলা হয়েছে সনাতন ধর্মে বিধবা বিবাহ সমর্থন করে —
নষ্ট মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পচস্বাপতসু নারীরাং পতিরন্যো বিধোযতে।।”
(পরাশর স্মৃতি সংহিতা ৪/২৭)
অর্থ — তাঁর স্বামী যদি গোপনে সন্ন্যাস গ্রহণ করে নিখোঁজ হয়ে যায়, নারীর যদি স্বামী মারা যায়, স্বামী যদি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়,স্বামী যদি নিখোঁজ হয়ে যায়, স্বামী যদি অধার্মিক ও অত্যাচারী হয় তবে নারী এই স্বামী ছেড়ে পুনরায় বিবাহ করতে পারবেন।
১২/হিন্দু ধর্মেরএই সম্পর্কে কি বলে পবিত্র বেদ দেখা যাকঃধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্ম্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।। (ঋগ্বেদ ১০.১৮.৭-৮)
অর্থাৎ— হে মনুষ্য! সে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া যাতে সন্তানাদি এবং সুখভোগ করতে পারে।এই স্ত্রী পুনর্বিবাহের আকাঙ্খা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার নিকট আসিয়াছে।
১৩/ বিধবাদের পুনরায় বিবাহ করার অনুমতি দিয়ে তৈত্তিরীয় আরন্যক এ বলা হয়েছে স্বামীর মৃত্যুর পর (৬.১.১৪ )
“হে নারী! তুমি এই মৃতপতির মায়ায় আবদ্ধ হয়ে আছো।এই মায়াত্যগ কর। পুনরায় পতি কামনা করো এবং পাণিগ্রহনকারী (নতুন পতি) বিবাহের অভিশাষী এই পতিকে জায়াত্বের সহিত প্রাপ্ত হও”অর্থাত্ এখানে স্বামীমৃত্যুর পর স্ত্রীকে দুঃখে কাতর না হতে,শোকত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে বলা হয়েছে এবং প্রয়োজনে পুনরায় বিবাহ করার অনুমতি দিয়েছেন।
সনাতন ধর্মে কি নারীর পুনর্বিবাহের অধিকার আছে এ বিষয়ে বেদ কি বলে --
ঋগ্বেদ ১০.১৮.৭-৮ এ স্বামীর মৃত্যুতে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল বা সামাজিকভাবে সমস্যার সম্মুখীন বিধবা মহিলাকে পুনর্বিবাহের অনুমতি দেয়া হয়েছে। চাহিদা পুরন করতে না পারলে বা স্বামী যদি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয় তবে স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
নষ্ট মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পচস্বাপত্সু নারীরাং পতিরন্যো বিধোয়তে।।" স্মৃতিশাস্ত্র পরাশর সংহিতায় বলা হয়েছে (পরাশর সংহিতা ৪.৩০)
অনুবাদ- নারীর যদি স্বামী মারা যায়, তার স্বামী যদি গোপনে সন্ন্যাস গ্রহণ করে, স্বামী যদি নিখোঁজ হয়, স্বামী যদি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়, স্ত্রী এই স্বামী ছেড়ে পুনরায় বিবাহ করতে পারে যদি স্বামী অধার্মিক ও অত্যাচারী হয় তবে।
উপর্যুক্ত ক্ষেত্রে হিন্দু নারী দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারেন। তবে তার পূর্বে বর্তমান স্বামীকে সংশোধন বা প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত সময়কাল অপেক্ষা করতে হবে। তাতেও স্বামী নিজেকে সংশোধন না করলে, নপুংসকতা দূর না হলে বা নিখোঁজ থেকে ফিরে না আসলে স্ত্রী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারবে।
আবার অপরদিকে বল এটাও বলা আছে
নিষিদ্ধের এর চেয়ে স্পষ্ট নিদর্শন আর কি থাকতে পারে --বহুবিবাহ পাপঃ — !
একসাথে থাকবেন পতি ও পত্নী মৃত্যু পর্যন্ত । তারা অন্য কোন জীবনসঙ্গী গ্রহণ করবেন না বা ব্যাভিচার করবেন না। নারী-পুরুষের পরম ধর্ম এটাই ।
(মনুসংহিতা, ৯/১০১)
তাই বহুবিবাহ যে সব সমাজ অথবা যৌন-দাসত্ব ও সাময়িক বিবাহের মতো জঘণ্য আচারকে অনুমোদন দান করে ধর্মসূত্র লঙ্ঘনের দায়ে দুর্দশা ভোগ করতে বাধ্য হয় সেই সমাজের মানুষগন।একের অধিক স্ত্রীর অস্তিত্ব মানেই জাগতিক সকল দুঃখের আনায়ন হতে পারে -ঋগ্বেদ, ১০/১০৫/৮ ।
দুই স্ত্রীযুক্ত ব্যক্তিকে সেভাবেই কাঁদতে হয় ঠিক যেভাবে চলমান রথের ঘোড়া উভয় দিক থেকে চাবুক এর আঘাতে হ্রেষা রব করে--ঋগ্বেদ, ১০/১০১/১১ বলেছে! একাধিক স্ত্রী জীবনকে লক্ষহীন করে তোলে --(ঋগ্বেদ, ১০/১০১/১১
একজন নারীর কখনো যেন কোন সতীন (Co-wife) যেন না থাকে --অথর্ববেদ, ৩/১৮/২।
👉|পুনর্বিবাহ ব্যবস্থা কি ||
পুরুষের ব্যাপারে মনুস্মৃতি যা বলছে তা হলো-একজন দ্বিজব্যাক্তি /মর্যাদাসম্পন্ন ব্যাক্তি, বিধিমতে বিবাহিত স্ত্রীর মৃত্যুর পর, তাকে পবিত্র অগ্নিতে দাহ করবে। যথা নিয়মে অন্তিম সংস্কার সম্পন্ন করে, সে পুনরায় বিবাহ করতে পারে এবং অগ্নি প্রজ্বলন করতে পারে। এই নিয়মে থেকে সে কখনোই তার পঞ্চযজ্ঞ ত্যাগ করবে না। দ্বিতীয়বারের মতো সে তার স্ত্রীকে নিয়ে নিজের গৃহে বসবাস করবে।
(মনুস্মৃতি, ৫/১৬৭-১৬৯)উল্লেখ্য যে, এখানে একগামী ব্যবস্থারই প্রচলিত ইঙ্গিত পাচ্ছে।নারীর ব্যাপারে মনুস্মৃতি যদিও পুনর্বিবাহের উল্লেখ করে, তাও এটি সুনীতি সম্পন্ন নারীদের করতে নিষেধ করে। অন্যদিকে পরাশর সংহিতা বলছে—সন্যাস গ্রহণে,অক্ষম অধার্মিক বা অত্যাচারী,পতির প্রয়াণে, নিরুদ্দেশাবস্থায় হলে নারী স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদ করে পুনরায় বিবাহ করতে পারবে।
(পরাশর সংহিতা, ৪/২৬)যিনি বিধবা বিবাহ আইন পাস করে অকাল বৈধব্যের বোঝা থেকে অনেক নারীকে মূক্ত করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এই জন্য বিশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করি, । উল্লেখ্য যে, বেদ দেবর কে দ্বিতীয় বর হিসাবে উল্লেখ করে। স্বামীর মৃত্যুর পর দেবর স্বামীর সকল দায়িত্ব পালন করার কথা যেমন দেখা যায়, তেমনি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে বিধবার সহিত দেবরের সহবাসের কথাও উল্লেখ করে।
এখানে মনুস্মৃতিও বলছে—তবে তার দেবর যথা বিধিতে তাকে বিবাহ করতে পারবে যদি কোনো স্ত্রীর স্বামী (দুর্ঘটনায় বা অকালে) মারা যায়, ।
(মনুস্মৃতি, ৯/৬৯)
তাকে তুচ্ছ বলে গণ্য করা হবে যে নারী তার স্বামীকে ত্যাগ করে, উচ্চবর্ণের তথা বিত্তশালীর সাথে সহবাস করে।
(মনুস্মৃতি, ৫/১৬৩)
অতএব দুই রাস্তাই খোলা আছে। নিজের ইচ্ছা এবং বিজ্ঞের মতামত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাই শ্রেয়।
👉আবার পর্বে নারীদের স্বামী মারানি মারা যাওয়া নিয়ে নিয়ে কুসংস্কার ছিল
হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে বা আত্মহুতি দেবার ঐতিহাসিক প্রথা হচ্ছে সতীদাহ , যা রাজা রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বন্ধ হয়। মূলত উত্তরে এবং প্রাক আধুনিক যুগে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে এই প্রথা পালিত হতে দেখা যেত ৷কোন সময় থেকে এই প্রথার উদ্ভব হয় এটা নিয়ে তেমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় নি ৷