রহস্যময় সিন্দুর মতি পুকুরের ইতিহাস

রহস্যময় সিন্দুর মতি পুকুরের  ইতিবৃত্ত
লালমনিরহাট জেলা সদরের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত ইতিহাস প্রসিদ্ধ পুকুরটির নাম সিন্দুরমতি। এটি শুধু  একটি সুবিশাল প্রাচীন  পুকুর নয়,  হাজার হাজার  বছর ধরে হিন্দুদের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র হিসেবে মানিত হয়ে আসছে। প্রাচীনকালে খনিত পুকুরটির  তথ্য সম্বলিত গ্রন্থ  বা প্রামাণ্যে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে  এটি কোন সময়ে সৃষ্টি  হয়েছে  তা নির্ণয়  সন্ভব হয়নি।  প্রাচীন কাহিনী  ও  কিংবদন্তী সংগ্রহ করা  যত সহজ  কিন্তু সন -তারিখ নির্ধারন বা অনুমান করা সহজ নয়। স্থানীয় প্রবীণদের মতে  পুকুরটি  ত্রেতাযুগে সৃষ্টি ।  অনেকের মতে  বাংলা ১৩ সনের চৈত্র মাসের  রাম নবমীতে সৃষ্টি। কেহ কেহ বলেন, সিন্দুর মতি পুকুরের ন্যায় বাংলাদেশে  অনেক পুকুর আছে।  

রহস্যময় সিন্দুর মতি পুকুরের  ইতিহাস
সিন্দুর মতি দীঘির রহস্য 


যেমন বরিশালের মাধব পাশায় ' দুর্গা সাগর '  রাণী দুর্গাবতী কর্তৃক ১৭ খ্রীষ্টাব্দে  প্রকান্ড দীঘিটি খনিত হয়। পটুয়াখালী জেলার কচুয়া নামক স্থানে রাণী কমলা কর্তৃক 'কমলার দীঘি ' খনিত হয় পাঠান  আমলে।  জয়পুরহাট জেলার ' নান্দাইল দীঘি ' রাজা নন্দলাল কর্তৃক ১৬ খ্রীষ্টাব্দে  খনন করা হয়। জামালপুর জেলার ' ঝিনাই পাড়ের  ' চন্দ্রাবতী দীঘি ' রাজা হরিশ চন্দ্র কর্তৃক সংস্থাপিত করা হয়। আবার অনেকে বলেন, ১৫১৩খ্রীস্টাবে (মধ্যযুগে) কুচবিহার রাজবংশের একটা অংশ পাঙ্গায়  একটি ছোট রাজ্য স্থাপন করেন। সে সময় পাঙ্গায় রাজার সাথে অনেক মৈথিলী ব্রাক্ষন  এসেছিল। রাজা তাদের খুব সমাদর করতেন এবং নিস্কর ভুমিদান করে এ দেশে স্থায়ীভাবে  বসবাসের সু ব্যবস্থা করে দিতেন। অনেকের ধারনা, ওই ব্রাক্ষনের বংশধর রাজনারায়ন সিন্দুরমতিতে বসতি স্থাপন করে ছিলেন। যা হোক, উপরিলিখিত কিংবদন্তী পুকুর সমুহ মধ্য  যুগে খনিত এবং সৃষ্টি রহস্য একই  রুপ। জীবন বির্সজনের বিনিময়ে এ সব দীঘিকায় জলের পরিপূন্যতা লাভ করেছিল ।

 
     অপরদিকে সিন্দুরমতি  পুকুরের সুন্দর  সৃষ্টি কাহিনী রয়েছে। জনশুতি রয়েছে    রাজা রাজ নারায়ন একজন ধার্মিক ও দানবীর ব্রাক্ষন ছিলেন। তার স্রী মেনেকাদেবী  ছিলেন দেবভক্তি মনা ও পতিপ্রানা। রাজ নারায়ন অল্পদিনের মধ্যে অত্র এলাকায় প্রতিষ্ঠিত  করেন নতুন জমিদারিত্ব। ভগবানের আরাধনায় মেনেকা দেবী যথাক্রুমে লাভ করেন চন্দ্রিকা সদৃশ্য সুললিত দু  কন্যা সিন্দুর আর মতি।
  একদা সময় রাজ্যে  তীব্র খরা দেখা দেয়। প্রজাদেন পানীয় জলের কষ্ট লাঘবে রাজা ১৭ একর জমির উপর এক বিশাল পুকুর খনন করেন । কিন্তু আর্শ্চাযর বিষয় পুকুরে এক ফোটা জলের চিহ্ন পাওয়া গেল না। রাতে রাজ্কে স্বপ্নাদেশ করা হলো - তার দু কন্যাকে দিয়ে পুকুরে পুজা করলে তবে জল আসবে। জমিদার স্বপ্নাদেশ অনুযাই রামনবমীতে পুজার আয়োজন করলেন। পুজা স্থলে দুটি লোহার সিন্দুক ও দুটি পাঠা আনা হয়। উপাসিত সিন্দুরমতি এক সাথে দেবতাকে বরন তরে নিচ্ছিলেন । ঠিক তখনি রাজার মনে পড়ে যায় তুলসী পাতা ছেড়ে এসেছেন। তিনি তুলসী পাতা আনতে গেলে সহসা বিকট শব্দে পুকুরের তলদেশ ভেদ করে তীব্রবেগে অজস্র জলরাশি বের হতে লাগল। নিমিষেই পুকুর কানায় কানায়  জলে পরিপুর্ণ হলো। কোনমতে সবাই সাতরিয়ে ডাঙ্গায় উঠে। কিন্তু উঠতে পারলো না সিন্দুর আর মতি। ইত্যবসরে জমিদার ফিরে এসে দেখেন সব শেষ। তিনি শোকে মুর্ছিত হয়ে পড়েন। মেনেকা দেবীও শোকে শর্য্যাশায়ী হয়ে পড়েন।


   লীলাময় ভগবান আবার এক রাতে স্বপ্নাদেশে জানান, তার দু কন্যার মৃত্যু হয়নি  পুকুরের তলদেশে দেবত্বপ্রাপ্ত  হয়ে চির অমরত্ব  লাভ করেছে। দৈব বাণীর কথায় জমিদার মনে শান্তি পেলেন । তবে তিনি স্বচোখে  দু কন্যাকে দেখার  বাসনা ব্যক্ত করেন। জমিদারের মনের বাসনা পুরনে অষ্টম দিনের মাথায়  অতি ভোরে  পুকুরে ভাসমান জলে প্রথমে আলোহিত ও জ্যোতিময় মন্ডলে  সিন্দুর ও মতির শাড়ীর আঁচল এবং কনিষ্ঠাঙ্গালি দেখান। পরে দু কন্যার সাথে কথাও বলেন। সিন্দুর ও মতি জানান, তাদের জীবন উৎসর্গের নির্মিত্তে উক্ত স্থানটি পবিত্র তীর্থ ক্ষেত্র হিসেবে চিরকাল পূজিত হবে।
    জনশুতি আছে যে,  সে সময় থেকে চৈত্রমাসের  রামনবমী তিথিতে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সিন্দুরমতি পুকুরে  পুণ্যস্নানের প্রচলন হয় এবং পবিত্র তীর্থটির মাহাত্ব্য  চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কবিতার  দুটি লাইন দিয়ে সমাপ্তি টানছি ---সিন্দুর মতির এই সেই দীঘি,
                    হিন্দু তীর্থ স্থান
                পুুন্যের লাগি হিন্দুরা সব,
               করে যায় হেথা স্নান।।


Next Post Previous Post
1 Comments
  • নামহীন
    নামহীন ৫ এপ্রিল, ২০২২ এ ৯:৪৮ PM

    জয় সিন্দুর মতির জয়।

Add Comment
comment url