শিবলিঙ্গ বা লিঙ্গপুজা কি? এটা কি সত্যি পুরুষাঙ্গ নাকি?

আপনাদের প্রথমেই জানতে হবে, এই লিঙ্গ একটি সংস্কৃত শব্দ। বাংলা আর সংস্কৃত শব্দ বা ভাষা এক নয়। এক দেশের ভাষায় বুলি আরেক দেশের ভাষায় গালি। তাই যে শব্দটি যেই ভাষা থেকে এসেছে, সেই ভাষার অর্থই প্রয়োগ করতে হবে। লিঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত লিঙ্গম শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। আর শিব অর্থ মঙ্গলময় ঈশ্বর।অপরদিকে  সংস্কৃত ভাষায় পুরুষাঙ্গকে বলা হয় "শিশ্ন" সুতরাং, শিবলিঙ্গ অর্থ হচ্ছে মঙ্গলময় ঈশ্বরের প্রতীক বা চিহ্ন। ধ্যানমগ্ন শিবকে এই প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। আমরা যেমন ধোঁয়া দেখে আগুনের অস্তিত্ব অনুধাবন করি, পতাকা দেখে দেশকে অনুধাবন করি, ঠিক তেমনি শিবলিঙ্গের মাধ্যমে ভগবান শিবের উপলব্ধি করি।🌺

শিবলিঙ্গ বা লিঙ্গপুজা
শিবলিঙ্গ পুজা
🌺অনেকেই শিবলিঙ্গ বলতে শিবের পুরুষাঙ্গ (যৌনাঙ্গ) বুঝে। বিশেষ করে যারা ইউটিউবে, শিবলিঙ্গ এর ভুল ভিডিওটি দেখেছেন।🌼🌼সেখানে ছিল, ঋষিরা একটি মহাযজ্ঞ করেন। কিন্তু ঋষিরা জানতেন না এই যজ্ঞের ফল কার প্রাপ্তি। এজন্য ঋষিদেরমধ্যে ভৃগু নামক ঋষিকে এই যোগ্য ফলদাতাকে নির্বাচন করার দ্বায়িত্ব দেওয়া হলো। ভৃগু ঋষি প্রথমেই গেলেন ব্রহ্মলোকে। সেখানে গিয়ে দেখেন ভগবান ব্রহ্মা আর মাতা সরস্বতী গভীর বেদ চর্চ্চায় মগ্ন। তার আগমন ব্রহ্মার নজর পড়ে নি। এতে মহর্ষি ভৃগু অপমান বোধ করেন। তিনি ক্রোধ হয়ে, ভগবান ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিলেন আজ থেকে পৃথিবীতে তার পূজা হবে না।তারপর তিনি গেলেন কৈলাশে। সেখানে গিয়ে দেখেন ভগবান শিব আরপার্বতী যৌন মিলনে ব্যস্ত। এতে মহর্ষি ভৃগু ক্রোধ হয়ে ভগবান শিবকে অভিশাপ দেন, আজ থেকে পৃথিবীতে আপনার মূর্তিতে পূজা হবে না, পূজা হবে আপনার লিঙ্গরূপে। তার ক্রোধ হয়ে ভৃগু গেলেন বৈকুণ্ঠে। সেখানে গিয়ে দেখেন ভগবান বিষ্ণু অনন্তশয্যায় নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তিনি বিষ্ণুর নিদ্রা ভঙ্গ করার চেষ্টা করেন কিন্তু ভঙ্গ হয় না বলে তিনি ভগবান বিষ্ণুর বুকে বাম পা দিয়ে লাথি মারে।

এগুলো যে মিথ্যা তার প্রমাণ তুলে ধরছি

🌹🌹গীতার ১৬/২১ এ বলা আছে, কাম,ক্রোধ এবং লোভ এই তিনটি নরকের দ্বার স্বরূপ।🌹🌹🌺🌺তাহলে ভৃগু কি করে ক্রোধ করতে পারে এবং ভগবান শিব কেন যৌন মিলন করবে। আর শাস্ত্রে বলা আছে, সর্বভুতে ঈশ্বর অর্থাৎ, ঈশ্বর সর্বত্রই বিরাজিত। তিনি সর্বত্রই জাগ্রত।ভগবানের দৃষ্টি থেকে কিছুই আড়াল হয় না। আর তাহলে কি করে ব্রহ্মা ভৃগুকে খেয়াল করবে না।ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব আলাদা নন। বেদে বলা আছে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।🌹🌹ন দ্বিতীয় ন তৃতীয়, চতুর্থ ন পুচ্যতেন পঞ্চম ন ষষ্ঠ, সপ্ত্য ন পুচ্যতেন অষ্টম ন নবম, দশমো ন পুচ্যতেয এতং দেভ মেক বৃতং বেদ ( অথর্ববেদ সুক্ত ১৪/৪/২)।অর্থাৎ, পরমাত্মা ( ঈশ্বর) এক। তিনি ছাড়া কেউ ২য়, তয় বা ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ বা ৭ম, ৮ম, ৯ম বা ১০ম বলিয়া অভিহিত আর কেউ নাই।

🌹🌹🌼🌼আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে - ভগবান অভিশাপের উর্ধ্বে। ভগবান কর্ম অনুযায়ী, সকলকে ফল প্রদান করেন। ঈশ্বর নিরাকার, তিনি সকল জীবের মধ্যে অবস্থিত। তাকে খোজার জন্য ব্রহ্মলোক, কৈলাশ বা বৈকুণ্ঠধাম যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। একমনে ভক্তিভরে তার আরাধনা বা উপসনা করলেই হয়। ঈশ্বর না চাইলে, ঈশ্বরকে দেখা বা ধরা ছোয়া যাবে না কিন্তু এখানে ভৃগু ভগবান বিষ্ণুর বুকে বাম পা দিয়ে লাথি বা পারা মারেন। যা কল্পনার চেয়ে ও কল্পনাহীন।

🌷🌷শিবলিঙ্গকে পুরুষাঙ্গ মনে করা ভ্রান্ত ধারণা।শাস্ত্রে শিব বলতে, নিরাকার সর্বব্যাপী পরমাত্মা বা পরম ব্রহ্মকে বুঝায়। নিরাকার পরমাত্মার কোনো পুরুষাঙ্গ থাকতেই পারে না।পুরুষাঙ্গ সংস্কৃত শব্দ হচ্ছে শিশ্ন আর সংস্কৃততে লিঙ্গ অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। শিবলিঙ্গের উপরে ৩টা সাদা দাগ থাকে যা ভগবান শিবের কপালে ও থাকে। যদি শিবলিঙ্গ পুরুষাঙ্গ হতো তাহলে শিবলিঙ্গের উপরে ৩ টা তিলক রেখা থাকতো না। শিবলিঙ্গ ৩ টা অংশ নিয়ে গঠিত। সবার নিচের অংশকে ব্রহ্মাপীঠ, মধ্য অংশ বিষ্ণুপীঠ আর সবার উপরের অংশকে শিবপীঠ বলা হয়।

🌷🌷শিবপুরান অনুসারে, ভগবান শিবই একমাত্র ব্রহ্মরূপ হওয়ায় তাকে নিষ্কল( নিরাকার) বলা হয়। যেহেতু শিব সর্বশক্তিমান তাই তিনি জগতের কল্যাণের জন্য রূপ ধারণ ও করতে পারেন। রূপবান হওয়ার জন্য তাকে "সকল" ( সাকার) বলা হয়। তাই তিনি সকল ও নিষ্কল দুইই। শিব নিষ্কল হওয়ায় তারপূজার আধারভূত শিবলিঙ্গ রূপে করা হয়। আমরা সত্য, ত্রেতা আর দ্বাপর যুগেও দেখেছি, কোনো প্রতীক বা ঘট বা যজ্ঞের মাধ্যমে ভগবানের আরাধনা-উপাসনা বা পুজা করা হতো।

🌺🌺🌺🌺১৯০০ সালে প্যারিসে ধর্মীয় আলোচনায় স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, শিবলিঙ্গ কথাটি এসেছে, অথর্ববেদ সংহিতা গ্রন্থে যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ নামে একপ্রকার বলিদান স্তম্ভের স্তোত্র থেকে, কারণ এখানেই প্রথম শিবলিঙ্গ পূজারকথা জানা যায়। এই স্তোত্রে আদি ও অন্তহীন এক স্তম্ভ বা স্কম্ভ এর বর্ননা পাওয়া যায়, এই স্তম্ভটি চিরন্তন ব্রহ্মের স্থলে স্থাপিত। যজ্ঞের আগুন, ধোঁয়া, ছাই, সোমলতা এবং যজ্ঞকাষ্ঠবাহী ষাঁড়ের ধারনাটি থেকে শিবের উজ্জ্বল দেহ তার জটাজাল, নীলকন্ঠ ও বাহন বৃষের একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাই মনে করা হয়, উক্ত যূপস্তম্ভই কালক্রমে শিবলিঙ্গের রূপ ধারণ করেছে।

🌺🌺🌹🌹বিজ্ঞানী নিলস বোরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, শিবলিঙ্গ ৩ অনুর উপাদান দ্বারা গঠিত। যথাঃ প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন। এই ৩ উপাদান দ্বারাই তৈরি হয়েছে আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। তাই বলা যায়-শিবলিঙ্গ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডএর প্রতীক।

🌹🌹🌷🌷স্কন্দ পুরানে কথিত আছে আকাশ লিঙ্গ মিত্যাহু পৃথিবী তস্য পীঠিকাআলয় সর্ব্বদেবানাং লয়না লিঙ্গ মুচ্যতে।অর্থঃ এই সুবিশাল আকাশই হলো লিঙ্গ আর পৃথিবী আকাশের বেদীকা। এই আকাশেই সর্বদেবদেবী লয়প্রাপ্ত হন অর্থাৎ লিঙ্গরূপ এই মহাশক্তির মধ্যেই সকল দৈব্যশক্তি বিলীন হয়ে যায়। তাই তাকে লিঙ্গ নামে অভিহিত করা হয়।🌷🌷আশা করি পড়ে সবার ভুল ধারণা দূর হবে।

#তাগ;

শিবলিঙ্গ,শিবলিঙ্গ পূজা কেন করা হয়,শিব লিঙ্গ পূজা,লিঙ্গ পুজা,হিন্দুদের শিব লিঙ্গ পুজা,শিব লিঙ্গ,লিঙ্গ শিব,হিন্দুদের লিঙ্গ পুজা,হিন্দুরা কিভাবে লিঙ্গ পূজা করে,লিঙ্গ,শিব লিঙ্গ পূজা কি,হিন্দুদের শিবলিঙ্গ বা লিঙ্গপুজা কি?


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url