গীতার কর্মযোগ ব্যাখ্যা
গীতার কর্মযোগ বাংলা
মহাভারতে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে এসে আত্মীয়স্বজন ও নিজ রাজ্যের সৈন্য সামন্ত দেখে যুদ্ধ করতে চাইছিলেন না। অর্জুন যুদ্ধ না করার পেক্ষিতে যুক্তি দেখাচ্ছিলেন যে,মহান মহান গুরুতুল্য আত্মীয় সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তি ও নিজ ভাগিগনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁদের রক্তে রাঙা সাম্রাজ্য ভোগ করে আমার জীবনে কোনও সুখ-শান্তি পেতে পারব না। আমি যুদ্ধ চাই না, বরং তারা সবাই যুদ্ধ করতে এসেছে তারা আমাকে মেরে ফেলুক- আমার দুঃখ নেই। বরং ভিক্ষুক হয়ে অন্যত্র গিয়ে জীবন কাটানো শ্রেয়স্কর। এই যুদ্ধের ফলে বহু নারী পতিহীন হবে। এই সমস্ত মহাত্মা বীরেরা সমাজের নারী ও বালকদের উপদেষ্টা রূপে কাজ করে। তারা যখন যুদ্ধে প্রাণ দেবে তখন সমস্ত সমাজ বিধর্মী ভাবধারায় চলতে থাকবে। বর্ণসঙ্কর প্রজাতির জন্ম হবে। অনাচার- বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না।
তারপর অর্জুনকে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধি যোগে কর্ম করতে হয়। কর্ম ছাড়া কেউ থাকতে পারে না। মুহূর্তের জন্যও নিষ্কর্মা হয়ে থাকা উচিত নয়। হে অর্জুন, তুমি এমন অভিজ্ঞ যোগী নও যে, যুদ্ধকর্ম ত্যাগ করে বসে বসে ইন্দ্রিয় সংযম তথা মন স্থির হয়ে জীবন কাটাতে পারবে।
গীতার কর্মযোগ |
মানুষের মন যখন স্থির হয় মনোসংযমের ফলে , তখন তার কর্তব্য-অকর্তব্য উপলব্ধি হয়। মনকে স্থির রাখার নামই ধ্যান। যোগীরা বসে বসে পরমাত্মার ধ্যান করতেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধ্যান করতে বলেননি। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় সেনাপতি অর্জুনের কর্তব্য যুদ্ধ করা। যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধ না করার এই মনোভাব ভাল নয়। অর্জুন যদি শান্তির উদ্দেশ্যে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে বনে চলে যান- আর ধ্যানও করতে থাকেন; তাহলেও স্বভাবতই তিনি পরমাত্মার বা ভগবানের ধ্যান না করে তাঁর ভাইদের কথা, দুর্যোধনের অত্যাচারের কথা চিন্তা করতে থাকবেন। ভগবানের চিন্তা বাদ দিয়ে তখন তাঁর শক্রপক্ষের কথাই স্মরণ হবে। মন বেশী বিক্ষুব্ধ হবে। আর সমস্ত বীরপুরুষেরা এমন কি নারীরাও অর্জুনের মতো বীর সেনাপতিকে নিন্দা ও উপহাস করতে থাকবে। এর ফলে অর্জুনের মন আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্যই তৈরি হবে। অতএব যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে ভিক্ষুক হয়েও মনে শান্তি সুখ পাবেন না।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগের শিক্ষা দিতে গিয়ে বলছেন, হে অর্জুন, তুমি পরম যোগী হও। তোমার জাগতিক কর্তব্য কর্ম সম্পাদন কর এবং সর্বদা আমার স্মরণ নাও। কোথাও পালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিক্ষা দিয়েছেন আমাদের কোন অবস্থার পরিবর্তন করার দরকার নেই। প্রয়োজন কেবল কর্তব্য কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে কৃষ্ণচিন্তা করা। আমাদের নিজ নিজ অবস্থার মধ্যে সর্বদাই কৃষ্ণকে চিন্তা করতে হবে। যেখানেই থাক হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ-কীর্তনাদি করতেই হবে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন, অর্জুন যেন রণাঙ্গনেই প্রবৃত্ত থাকেন এবং এইভাবে এই যুদ্ধক্ষেত্রে থেকেই পারমার্থিক পথে অগ্রসর হতে পারেন। শক্রপক্ষের লক্ষ লক্ষ বাণ আসছে সে সম্বন্ধে সদা সতর্ক থাকতে হবে, সেই সঙ্গে পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশেই আমি যুদ্ধ করব সেই মনোভাব থাকবে।
প্রত্যেকের স্বভাব এক নয় এই জগতে । স্বভাব অনুসারে লোকে কর্ম করে। ক্ষত্রিয় স্বভাব মানেই তার যুদ্ধ করার প্রবণতা প্রবল। তার মনে ক্রোধভাব থাকে। তাকে যুদ্ধ করতে হয়। আমরা জানি ক্রোধ ভাল গুণ নয়। ক্রোধকে সংযত করতে হয়। কিন্তু অর্জুন যেহেতু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে যুদ্ধ করছিলেন তাই সেই যুদ্ধ কর্মের মাধ্যমেই তাঁর পারমার্থিক সিদ্ধি লাভ করেছেন। অর্থাৎ আমাদের সমস্ত কর্ম প্রবণতা, আমাদের সমস্ত গুণ কৃষ্ণসেবায় নিয়োগ করতে হবে। অর্জুন তাঁর ক্ষাত্রভাব কর্ম শ্রীকৃষ্ণসেবায় নিয়োগ করেছিলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধানের খাতিরেই অর্জুন তার কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, তাই সেই কর্মটি অপ্রাকৃত কর্মে রূপান্তরিত হয়।
যখন কেবল জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দের উদ্দেশ্যেই আমাদের কর্মগুলি করা হয় তখন সেটাই এক সময় দুঃখ-শোকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেই সমস্ত কৃষ্ণপ্রীতি উদ্দেশ্যে করা হলে তা অপ্রাকৃত কর্মে রূপান্তরিত হয়। সেই কর্মযোগের কথা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে। ক্রোধ স্বভাবটি ভাল বিষয় না হতে পারে, কিন্তু রামভক্ত হনুমান সীতা অপহরণকারী রাবণের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে লংকা নগরী পুড়িয়ে দিয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্রকে খুশি করার জন্য। সেই ক্রোধটাও ভক্তি। সমস্ত গুণগুলো ভগবৎ প্রীতি উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পাদিত হলেই আমাদের পারমার্থিক কল্যাণ সাধিত হয়। আমাদের অবস্থান পরিবর্তনের দরকার নেই। কেবল চেতনার পরিবর্তনের দরকার আছে।
Xxxxx
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, গৃহে থাকো বনে থাকো সদা হরি বলে ডাকো। যে অবস্থায় থাকি না কেন শ্রীহরির প্রীতির উদ্দেশ্যেই জীবন ধারণ করতে হবে। যেটি এ জগতে ‘আমার জন্য’ করা হচ্ছে সেই চেতনা বাদ দিয়ে ‘কৃষ্ণের জন্য’ এই উদ্দেশ্য থাকতে হবে। প্রীতিভরে কৃষ্ণসেবা করলে কৃষ্ণ সেই সেবা প্রীতিভরেই গ্রহণ করেন।
শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী বলেছিলেন, কোন কোন ব্যক্তি সুখ পাচ্ছে না, তাই সুখী হওয়ার উদ্দেশ্যে অন্যত্র যায়। ‘সুখী হব’ এই চিন্তায় গৃহ ত্যাগ করে হিমালয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা থেকেই যায়। কারণ তার মনে নিজের সুখ পাওয়ার চিন্তা রয়েছে। অর্জুন ভাবছিলেন, যুদ্ধ সমস্যা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেলে সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সমস্যা তো থেকেই যাবে। সমস্যার চিন্তা তো তাঁকে ছাড়বে না।
শ্রীল প্রভুপাদ তাৎপর্যে বলছেন, প্রত্যেকের কিছু ইন্দ্রিয় সুখের প্রয়োজন থাকে। তাই বর্ণাশ্রম পন্থা অনুসারে ভগবানের নির্দেশ মতো তাদের চলা কর্তব্য। আমরা যদি সমাজ, ভালবাসা, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি চাই- তা হলে বর্ণাশ্রম পন্থা অনুসরণ করে চলতে হবে। সুষ্ঠুভাবে সেই পন্থা অনুসরণ করার মাধ্যমে আমরা জাগতিক সুখ লাভ করতেও পারব এবং পারমার্থিক দিকেও এগিয়ে চলতে পারব। বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করে চিত্তশুদ্ধি লাভ করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নির্দেশ দিচ্ছেন।
যোগ ধর্ম তপস্যার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মশুদ্ধি। সপ্তম অধ্যায় ২৮ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, হে অর্জুন, পূর্ব পূর্ব জন্মে বহু পুণ্যকর্ম ফলে তুমি আমাকে প্রাপ্ত হয়েছ। তুমি আমার নিত্য সেবক। সব ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে শুদ্ধতা লাভ করা। ফলে কৃষ্ণসেবক হতে পারা যাবে। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, বহু বহু জন্মের পর শুদ্ধতা লাভের ফলে কেউ বুঝতে পারে যে, ভগবান বাসুদেবই সবকিছুর কারণ। সহস্র সহস্র জন্ম সদাচার করার ফলে কেউ কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
শ্রীল প্রভুপাদ বলছেন, যার পুণ্য কর্ম করার ক্ষমতা ছিল কিন্তু সে করল না, কেবল তা চিন্তা করল মাত্র। এতে কোন সুফল হয় না। এভাবে নিজেকে প্রতারণা করা উচিত নয়। কলিযুগে পুণ্যকর্ম বা ভালকর্ম করা কঠিন। কেউ জানে না, কিভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়। প্রত্যেকেই পাপকর্ম করতে চায়। তাই শুদ্ধতা লাভ করা অসম্ভব। ভগবান ভক্তরূপে স্বয়ং এসে শিক্ষা দিলেন কিভাবে শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করতে হয়। কেবলমাত্র ভগবানের নাম গ্রহণের মাধ্যমে আমরা শুদ্ধি লাভ করতে পারি ও তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করতে পারি।
মহাপ্রভু বলেছেন- তোমাদের কোন পুণ্য নেই, তাই তোমাদের যোগ্যতা বিচার করি না। আমি যুগধর্ম উপস্থাপিত করছি সেটি গ্রহণ করলেই ভগবৎ চরণে আত্মসমর্পণ হয়ে যায়। অত্যন্ত কৃপাময় পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ জগতে নামরূপে অবতীর্ণ হয়ে সবার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। মহাবদান্য মহাপ্রভু ব্রহ্মাদিরও দুর্লভ কৃষ্ণপ্রেম যেচে যেচে বিনামূল্যে বিতরণ করছেন। এটি তাঁর অহৈতুকী কৃপা। সেই কৃপা পেতে হলে পাপ প্রবণতা ছাড়তে হবে। মহাপ্রভু বলছেন, যা দিচ্ছি তা যদি নাও তবে বহু বহু জন্ম এক মুহূর্তেই পার হয়ে যাবে।
পাপ ছেড়ে হরিনাম করতে থাকলে ক্রমশঃ কৃষ্ণভক্তির দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। এমন কোন পাপ নেই যা জগাই-মাধাই করেনি। শুধু তাই নয়, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মাথায় তারা ভীষণ আঘাত করেছিল। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু তবুও তাদের হরিনাম দিয়ে কৃপা করলেন। এইভাবে বহু দিনের অসংখ্য পাপরাশি মুছে গেল তাদের। এটি গৌর-নিতাইয়ের অভাবনীয় অহৈতুকী কৃপা।
পাশ্চাত্যের মানুষ কিই বা না পাপ করে, কিন্তু তারা শ্রীল প্রভুপাদের সংস্পর্শে এসেই হরিনাম করার মাধ্যমে পাপমুক্ত হচ্ছে। শ্রীল প্রভুপাদ মহাপ্রভুর কৃপা বিলিয়েছেন। কোটি কোটি জন্ম ধরে আমরা ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের চিন্তা করে এসেছি। সেই চিন্তা করা ছাড়তে হবে, পাপ প্রবণতা ছাড়তে হবে। হরিনাম করছি আর ইন্দ্রিয় তর্পণের কথা চিন্তা করছি- সেটি আত্ম-প্রতারণা। তা হলে বহু দূর পিছিয়ে যেতে হবে। নামবলে পাপাচার ও জড়-জাগতিক আসক্তি বজায় রাখা নাম-অপরাধের অন্তর্ভূক্ত।
কৃপালু শ্রীকৃষ্ণ নামরূপে অবতীর্ণ হয়ে কেবল বদ্ধ জীবেদের উদ্ধার করছেন তাই নয়, তাঁদের কৃষ্ণপ্রেমও দান করছেন। কিন্তু আমরা যদি প্রতারণা করি তবে কৃষ্ণ ও তাঁর ভক্তগণ কখনও প্রীত হবেন না, এমনকি কখনও শ্রীকৃষ্ণ তার কাছে প্রকাশিত হবেন না। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সামনে অবতীর্ণ হয়েছেন আমরা যদি তাঁকে ফাঁকি দিই তবে আমাদের শাস্তি দুর্ভোগ পেতে হবে। যেমন, ছোট্ট শিলারূপে শালগ্রাম রয়েছে। তুলসী ও জল পাওয়া যায়। যে কেউ ভক্তিভরে তুলসী পাতা ও জল দিয়ে অনায়াসে পূজা করতে পারে।