রিপু কয়টি ও কি কি এবং রিপু দমন অর্থ

ষড়রিপুঃ ষড়র অর্থ ছয় ও রিপুর অর্থ কণ্টক অথবা শত্রু,অর্থাৎ  ষড়রিপু হচ্ছে ছয়টি শত্রু , রিপু মানুষের চিত্ত যদি কোন কারনে রিপুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে মানুষ নিজের অজান্তেই অনেক ভুল কাজ করে ফেলে যা পরে পাপও রূপে গণ্য হয়।সেই ছয় রিপু হল:- কাম , ক্রোধ , লোভ , মদ, মোহ ও মাৎসর্য ।

রিপু কয়টি ও কি কি এবং রিপু দমন অর্থ
ষড়রিপু 


১...কাম রিপু (lust)- কাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো কামনা,বাসনা,আসঙ্গ লিপ্সা ইত্যাদি। মানুষ তার স্বচ্ছন্দে ও সুখ, সমৃদ্ধির জন্য যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ ও ভোগ বিলাসের দ্রব্য বাসনা করেথাকে । সেই অতিরিক্ত বাসনাকে কাম বলা হয় ।এছাড়াও কোন এক ব্যক্তির বিপরীত লিঙ্গের কোন ব্যক্তির শরীরের প্রতি আকর্ষণ বা সেই শরীর ভোগ করার ইচ্ছা কে বলা হয় কাম।অন্যন্য ৫টি রিপুর সৃষ্টির জন্য দায়ী ভয়ঙ্কর  এই কাম রিপু।

👉কাম রিপু থেকে মুক্তির উপায়ঃ কাম সর্বপ্রথম ইন্দ্রিয়ে প্রবিষ্ট হয়ে মন ও বুদ্ধিকে মোহিত করে এবং এর দ্বারা মানুষকে মোহিত করে। মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে এর আবাসস্থল বা অবলম্বন। তাই প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজের বশে এনে এই কাম রুপী শত্রুর বিনাশ করতে হয়। জীবনে যারা এই কামশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি,মান,সম্মান লাভ করে, তারাই পৌছাতে পারে সফলতার শীর্ষে।

২...ক্রোধ রিপুঃ(anger)- ক্রোধ শব্দের অর্থ হলো রোষ,দ্বেষ,চোট,ক্ষিপ্ততা,প্রকোপ,উষ্মা,গর্জন করা,উন্মাদনা,কোপ,প্রতিশোধ নেবার আবেগ প্রভৃতি । ক্রোধের অপর নাম রাগ। ক্রোধ বা রাগ দুই প্রকারঃ- রাগ এবং অনুরাগ। মানুষ অনেক সময় এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েন কামনার প্রতি যে,এই আসক্তি তার চিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে যতক্ষণ না কামনা পূর্ণ না হয় ততসঙ্গে সেই কামনার না পূর্ণ হওয়ার কারণ হিসেবে সে অন্য কাউকে মেনে নেন এবং নিজের অন্তরে দুঃখ শব্দ শব্দ বা প্রহার দ্বারা ব্যক্ত করে অন্যকে কষ্ট দিতে চায় এর কারণ হলো অপর এক বিকাররূপী এই ক্রোধ রিপু। অনেক সময় মানুষের অহংকার এ আঘাত করা হলেও সে এই প্রকার রিপু দ্বারা গ্রস্থ হয়। এই রিপু কে ক্রোধ বলে ।

👉ক্রোধ রিপু থেকে মুক্তির উপায়ঃ ক্রোধ খুবই দুর্জয় রিপু, ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে না পারলে জীবনের কোন কাজেই সফলতা আসে না । ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তার মধ্যে শিষ্টাচার,ভদ্রতা,আত্মপ্রতিষ্ঠা বাড়ে এবং সে সহজে বিদ্যা অর্জন করতে পারে। ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে হলে ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও ক্ষমা গুণের অধিকারী হতে হয়।

৩..লোভ(Greed)ঃ লোভমনোবাঞ্ছিত বস্তুর প্রাপ্তির পর ব্যক্তির মনে আরও অধিক প্রাপ্তির আশা ও ইচ্ছা সঞ্চার হয়, অনেক ক্ষেত্রে এই ইচ্ছাঅনুচিত জেনেও ব্যক্তি সেই বস্তু এর প্রতি ধাবিত হয় একটি রিপুর প্রভাবে। এই রিপুকে বলা হয় লোভ।

👉লোভ রিপু থেকে মুক্তির উপায়ঃ লোভ খুবই দুর্দমনীয় রিপু, অতিরিক্ত লোভের কারণে মানুষ বিবেকহীন হয়ে মনুষ্যত্ব, ধর্ম-কর্ম হারিয়ে ফেলে। লোভ রিপুকে বশীভূত করতে হলে একান্তভাবে আত্মসংযমী হতে হবে, সংযম অভ্যাস দ্বারা ও হিতাহিত বোধকে জাগ্রত করে লোভ রিপুকে বশীভূত করা যায়।

৪..মদ/অহংকার(arrogance/vanity)ঃ নিজেকে অন্যদের তুলনায় উৎকৃষ্ট মনে করা এবং অন্যদের নিকৃষ্ট মনে করে তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকরা ইহা ঘটে যে রিপুর প্রভাবে তাকে মদ বলা হয়। অর্থাৎ ব্যক্তির অহংকার একটি রিপু এবং এই রিপুকে মদ বলা হয়। অহংকার হলো দম্ভ, গর্ব, দর্প,মদ্য, প্রমত্ততা, বিহবল ভাব ইত্যাদি। অহংকার রিপু হচ্ছে কাম-ক্রোধ-লোভের অতি মাত্রায় বহিঃ প্রকাশ। অহংকার মানুষকে তার প্রকৃত অবস্থা থেকে বিকৃত করে দেয় এবং তার আসল রূপটি লোপ পায়। অহংকারী মানুষদের অধিকাংশই আত্মশ্লাঘায় ভোগে। এই আত্মশ্লাঘা (নিজের প্রশংসা) তার নিজের মধ্যে নিহিত আত্মবোধ বা আত্মদৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে সে পৃথিবীর সবকিছুই তুচ্ছ মনে করে ধরাকে সরা জ্ঞান করে থাকে। অহংকার জীবনের অর্জিত বা সঞ্চিত যাবতীয় সম্পদকে চোখের নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে। কথায় বলে- অহংকার পতনের মূল। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় যে, মানুষ অনেক সাধনা করে, ত্যাগ করে যা কিছু অর্জন করে তা সে অহংকারের কারণে ধরে রাখতে পারে না। তার অহংকার ধীরে ধীরে তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অহংকারী মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য খুব বেশি পীড়াপীড়ি করে থাকে। সর্বত্রই চায় তার সর্বোচ্চ সাফল্য এবং তাতে আত্মঅহংকারে স্ফীত হয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার প্রাণান্ত চেষ্টায় বিভোর-বিহবল হয়ে পড়ে। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি তো পায়ই না; উপরন্তু হীন ও ক্ষুদ্র বলেই স্বীকৃতি পায়।অহংকার রিপুর বশবর্তী মানুষের সাধারণত ইশ্বরে ভক্তি থাকে না, তার অতিদ্রুত মতিভ্রম ঘটে এবং এক পর্যায়ে মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়।

👉মদ/অহংকার রিপু থেকে মুক্তির উপায়-অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পেতে হলে ইশ্বরে ভক্তি এবং বিশ্বাস প্রয়োজন। মনের মধ্যে ভাবা দরকার আমি জীবনে যা কিছু পেয়েছি তাহা সব ভগবানের কৃপায়। সমাজের উচুতলার ধনী লোকের দিকে নজর না দিয়ে, গরীব-দুঃখী ও শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের দিকে গভীরভাবে মনযোগ নিবিষ্ট করলে ক্রমে-ক্রমে অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের কে বাড়াতে হবে বিশুদ্ধ তথা আসল জ্ঞান  কারণ প্রকৃত বা বিশুদ্ধ তথা আসল জ্ঞান যত বাড়বে অহংকার তত কমবে এবং অসম্পূর্ণ বা অপ্রকৃত জ্ঞান তথা নকল জ্ঞান যত বাড়বে অহংকার তত বাড়বে এবং এটা বাড়তেই থাকবে। 

৫..মোহ রিপুঃ (attachment) - স্বপ্ন কে সত্যি, অবাস্তবকে বাস্তব মনে করে এবং ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ক্ষণস্থায়ী কিছু কিছু বিষয়ের উপর ভ্রান্তধারণা পোষন করে তাতে মোহিত হয়ে থাকার নামই মোহ। যেমন অর্থ-সম্পদের মোহ, রূপের মোহ, পূরুষের পরস্ত্রীতে মোহ, নারীর পূরুষের উপর মোহ,সংসারের মোহ, নেশার মোহ ইত্যাদি।মোহঃ মোহমাত্রাতিরিক্ত অনিত্য বা নিত্য বস্তু এর প্রতি আসক্তি কে মোহ বলা হয় । কোন বস্তু বা ব্যক্তি এর প্রতি নিজের স্বাভাবিক অধিকার মনে করা এবং তাকে অন্য কারোর অধিকারে নাযেতে দেওয়া - যদি মানুষের এরকম মনোভাব তৈরি হয় কোন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি তাহলে ইহা হয় কোন এক রিপুর প্রভাবে। একে বলা যেতে পারে মোহ।

👉মোহ রিপু থেকে মুক্তির উপায়ঃ জ্ঞানীজনের উপদেশ,সৎসঙ্গ,সৎগুরু ও সাধুসঙ্গ ছাড়া মোহ রিপু থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। মানুষ মোহের বশবর্তী হয়ে যখন তার জীবন অতিবাহিত করে,তখন যদি সে কোন ভাবে তার মনের সামন্যতম অংশে সে মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালবাসা ও ঈশ্বরকে পাওয়ার মোহ সৃষ্টি করতে পারে,তাহলে সে ধীরে ধীরে মোহ রিপু থেকে মুক্তি পায় এবং মানব জীবনে আসে পরম শান্তি ।

৬..হিংসা রিপুঃ(envy/jealousy) - (মাৎসর্য্য রিপু) হিংসার আভিধানিক অর্থ হলো ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা,দ্বেষ,অনিষ্ট,পরশ্রীকাতরতা,বধ,হনন ইত্যাদি। হিংসার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পরশ্রীকাতরতা। পরশ্রীকাতরতা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে চরম অশান্তি ডেকে আনে। পরশ্রীকাতরতার তিনটি দিক রয়েছে। এক- অন্যের ভাল কিছু দেখলে তার গা জ্বলে যাওয়া।দুই -অপর কেউ ভাল কিছু করলে তার বিরোধিতা করা কিংবা ভাল কাজটির নেতিবাচক দিকগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে অন্যের সামনে হাজির করা। তিন- বেঁকে বসা /অমান্য করা(উর্ধ্বতন এর বেলায় ): ঘৃণা করা /অবজ্ঞা করা (অধস্তনদের বেলায়) । হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষের মন হিংসার আগুনে দাউ দাউ করে প্রতিনিয়ত জ্বলতে থাকে। অন্যের ভাল সহ্য করতে না পারা এবং অতি আপন জনকেও অযথা সন্দেহের চোখে দেখা হিংসা রিপুর কাজ। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষ অন্যের ভাল সহ্য করতে না পারার কারণে অপরের দুঃখে আনন্দিত হয়, অপরের আনন্দে হিংসা হয় এবং মনেমনে অপরের অনিষ্ট চিন্তা করে, কুট-কৌশলে অপরের ক্ষতি সাধন করে। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষ মায়াবী কাল সাপের মতো। They are schadenfreude.মাৎসর্যমাৎসর্য বা ঈর্ষা হল এমন এক প্রকার বিকৃতি যা অভাববোধ সে কারণে সৃষ্টি হয়।মানুষকে সর্বদা ভক্তি মার্গে থেকে রিপুর সাথে লড়াই করা উচিত ও নিজের চিত্তের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত যে ব্যক্তি রিপুরুপী বিগ কার থেকে মুক্ত হয়ে যায় সেই ব্যক্তি সাধারণ মানুষের চোখে মহান হয়ে যান।

👉মাৎসর্য/ঈর্ষা থেকে মুক্তির উপায়ঃ ঈর্ষা থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সমাজ, সমবণ্টন ও সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা রাখাটাও জরুরি।এছাড়া নিজের বোধ,বিবেচনা,বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এছাড়া ষড়রিপুর প্রভাব,ষড়রিপু কে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার জন্য আমাদের মন কে শান্ত ও পরিষ্কার রাখতে হবে, তার কারণ মন হলো জলের মতো মনে খারাপ চিন্তা এলে মন নর্দমার মতো নোংরা হয়ে যায়,কিন্তু যদি মনে ভালো চিন্তা আসে তাহলে সেটি গঙ্গা জলের মতো পবিত্র হয়ে যায়।

#ট্যাগঃষড়রিপু থেকে মুক্তির উপায়,

মোহ থেকে মুক্তির উপায়

ষড়রিপু নিয়ে গল্প

ষড়রিপু কাকে বলে

ষড়রিপু pdf

রিপু মানে কি

মোহ কাকে বলে

কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ মাৎসর্য অর্থ

মদ ও মাৎসর্য


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>