হিন্দু ধর্ম/সনাতন ধর্ম কি?

হিন্দু ধর্ম বা  সনাতন ধর্ম কি

  মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে একমাত্র  সনাতন ধর্ম  বিভিন্ন দর্শন, বিশ্বাস, আচার এবং বিবিধ মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে।হিন্দুধর্মকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। কারন এটি প্রাচীনযুগে আর্বিভূত হয়েছে। এবং ধর্মাবলম্বীরা একে সনাতন ধর্ম ("চিরন্তন নিয়ম বা চিরন্তন পথ") বলে আখ্যায়িত করেন।
হিন্দু ধর্ম/thehindu9.blogspot.com 

কিন্তু বর্তমানে জনসংখ্যার বিচারে আজ প্রায় ৯০০ মিলিয়ন অনুসারী নিয়ে হিন্দুধর্ম খ্রিস্টধর্ম  ও ইসলাম ধর্মের পরেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মমত।
পৃথিবীর অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে হিন্দু ধর্ম/সনাতন হলো বিশ্বের প্রাবীণ অর্থাৎ প্রধান ধর্ম, রীতিনীতি ও শিকড় ৪,০০০ বছরেরও বেশি পুরানো।আবার কিছু পন্ডিতের মতে,খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৫০০-এর সময়টি ছিলো বৈদিক যুগ নামে। সেই যুগের পরে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশত(৫০০) থেকে তিনশত(৩০০) এর মাঝে হিন্দুত্বের জন্ম হয়।

হিন্দুধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থ সমূহ ঃ
হিন্দুশাস্ত্রে দুটিভাগ রয়েছে একটি স্মৃতি  ও অন্যটি শ্রুতি। হিন্দুধর্ম গ্রন্থগুলিতে ধর্মতত্ব,পুরাণ ও দর্শন আলোচিত ও ধর্মানুশীলন সংক্রান্ত নানা তথ্যের বর্ননা করা  হয়েছে।সব গ্রন্থগুলির মধ্যে বেদ সবচেয়ে প্রাচীন।আর এই বেদ হলো প্রধান ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।এছাড়াও আরও প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হল পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ ও মহাভারত এবং ভগবতগীতা। ভগবতগীতা মহাভারতের কৃষ্ণ ও অর্জুনের  কথিত অংশ গুরুপ্তপুর্ন  ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে থাকে।হিন্দু  ধর্মের মানুষের মূল কথা, বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু রয়েছে, সেসবের মূলেই বিদ্যমান  ঈশ্বর।হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ধর্ম, অর্থ, কর্ম ও মুক্তিতেই বিশ্বাস এবং ভগবানের অস্তিত্বেই সবকিছুর অস্তিত্ব। হিন্দু ধর্ম হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত ধর্ম। তবে এই ধর্মে হিন্দু নামটি তুলনামূলকভাবে নতুন।
হিন্দু শব্দটি আসে মুলত সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা (তৃতীয় – দ্বিতীয় সহস্রাব্দ পূর্বে)  থেকে।হিন্দু ধর্ম এটি অনন্য ধর্ম  তবে এটি কোনো একক ধর্ম নয়,কারন বহু ঐতিহ্য এবং দর্শনের সংকলন রয়েছে এই ধর্মে।অপরদিকে কখনও কখনও একক, সংগঠিত ধর্মের বিপরীতে "জীবনধারা" বা "ধর্মের পরিবার" হিসাবে পরিচিত ঐই হিন্দু ধর্ম।হিন্দু ধর্ম অনুগামীরা বিশ্বাস করেন যে, তাদের ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর একাধিক পথ রয়েছে।অন্যান্য ধর্মের মতো, হিন্দু ধর্মের কোনও প্রতিষ্ঠাতা নেই, বরং এটি বিভিন্ন বিশ্বাসের মিশ্রণ।

গীতকৃষ্ণ ও অর্জুন/thehindu9.blogspot.com
হিন্দুরা সংসার, জীবন, মৃত্যু, এবং পুনর্জন্মের বা ধারাবাহিক চক্র এবং কর্মের  মতবাদগুলিতে বিশ্বাসী। হিন্দু ধর্মের অন্যতম মূল চিন্তা হ'ল 'আত্মা' বা আত্মার প্রতি বিশ্বাস। এই দর্শন ধরে যে জীবিত প্রাণীদের একটি আত্মা থাকে এবং তারা সকলেই পরমাত্মার অংশ।
 লক্ষ্যটি হল “মোক্ষ” বা মোক্ষ অর্জন, যা পুনর্বার  চক্রকে পরমাত্মার অংশে পরিণত করে।হিন্দু ধর্ম বৌদ্ধ, শিখ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম সহ অন্যান্য ভারতীয় ধর্মের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।

হিন্দু ধর্মের ও সনাতনধর্মের মধ্যে পার্থক্য 
প্রথমদিকে হিন্দু শব্দটি ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের সকল অধিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। কেবলমাত্র চৈতন্যচরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত ইত্যাদি কয়েকটি ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থে যবন বা ম্লেচ্ছদের থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পৃথক করার জন্য শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় বণিক ও ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসগুলির অনুগামীদের একত্রে হিন্দু নামে অভিহিত করে। ধীরে ধীরে এই শব্দটি আব্রাহামীয় ধর্মসমূহ অথবা অবৈদিক ধর্মবিশ্বাসগুলির (যেমন জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও শিখধর্ম) অনুগামী নন এবং সনাতন ধর্ম নামক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন সকল ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে পড়ে।

ইংরেজি ভাষাতে ভারতের স্থানীয় ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি বোঝাতে হিন্দুইজম বা হিন্দুধর্ম কথাটি চালু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে।ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি তথা বিশিষ্ট দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন হিন্দুধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে একে “একটি বিশ্বাসমাত্র” বলতে অস্বীকার করেন। বরং এই ধর্মের যুক্তি ও দর্শনের দিকটি বিচার করে তিনি খোলাখুলিভাবেই এই মত ব্যক্ত করেন যে হিন্দুধর্মের সংজ্ঞা দান করা অসম্ভব। শুধুমাত্র এই ধর্ম অনুশীলনই করা যায়। তার মতে হিন্দুত্বকে ধর্ম না বলে জীবন ব্যবস্থা বলা উত্তম।একই ধরনের মতামত মহাত্মা গান্ধী প্রদান করে বলেছেন, হিন্দুত্বের সকল মানুষকে নিজ নিজ বিশ্বাসের অনুবর্তী থেকে ঈশ্বরের উপাসনা করা যায়।এভাবে করে অন্যান্য ধর্মের লোকদের পাশাপাশি স্বীয় ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে শান্তি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করে জাগতিক তৃপ্তি লাভ করা যায়।

তেমনই কোনো কোনো পণ্ডিত সুসংজ্ঞায়িত ও রক্ষণশীল ধর্মীয় সংগঠন না বলে হিন্দুধর্মকে “অস্পষ্ট সীমানায়” বর্গায়িত করার পক্ষপাতী। কয়েকটি ধর্মমত হিন্দুধর্মে কেন্দ্রীয়। অন্যগুলি ঠিক কেন্দ্রীয় না হলেও এই পরিসীমার আওতার মধ্যেই পড়ে। এরই ভিত্তিতে ফেরো-লুজি হিন্দুধর্মের সংজ্ঞায়নে একটি “উদাহরণমূলক তাত্ত্বিক অন্বেষণ” (“প্রোটোটাইপ থিওরি অ্যাপ্রোচ”) চালিয়েছেন।

তাই শ্রীগোবিন্দ দাস বলেন-No definition is possible for religion, because it is undefined. [Hinduism: 45]

একই সুরে রাধাকৃষ্ণ এভাবে সংজ্ঞা প্রদান করে বলেছেন-Nothing is more difficult to be defined than Hinduism.

শ্রী গিরির মতে,বেদে স্বপ্রমিত ও সতঃসিদ্ব সত্যরাজি নিহিত এই কথা যে বিশ্বাস করে সেই হিন্দু আর তার এই ধর্মকে হিন্দু ধর্ম বলে।

স্বামী শ্রী বিষ্ণু শিবানান্দ গিরী তার রচিত হিন্দু ধর্মের প্রবেশিকায় লিখেছেন,ভারতে উদ্ভূত যেকোন ধর্মে যিনি বিশ্বাসী হবেন, তিনিই হিন্দু।

কিন্তু এই বক্তব্য সঠিক নয়।কারণ ভারতের লোকেরা পরবর্তীতে বিভিন্ন ধর্ম তথা বৌদ্ব,জৈন,ব্রাহ্ম,বিষ্ণু প্রভ্রৃতি ধর্মের অনুসারী হওয়া শুরু করে। তাই ভ্যানকাটা রমন বলেন,যেসব ব্যক্তি ইসলাম,জৈন,বৌদ্ব,খ্রীষ্টান,পার্সী,ইয়াহূদী যা জগতের অন্যান্য ধর্মের অন্তর্ভূক্ত নয় এবং যাদের উপাসনার রুপ একেশ্বরবাদ থেকে ফেটিশবাদ পর্যন্ত প্রসারিত এবং যার ধর্মতত্ত্ব সম্পূর্ণরুপে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত তাদেরকে হিন্দু রুপে এবং তাদের অবলম্বিত ধর্ম হল হিন্দু ধর্ম।

ড. পরেশমণ্ডল ও ড. দিলীপ কুমাড় ভট্টাচার্য বলেন,বৈদিক এবং বেদ অনুমোদিত পৌরাণিক আদর্শ যারা সমাদর করে,বেদে ধর্মীয় শাস্ত্রানানোমোদিত বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা ধর্ম সাধনা,উপাসনা করেন এবং সনাতন ধর্মের কল্যাণ চিন্তাকে জীবনের প্রয়োগ করে,জীবন-যাপন করে তারা হিন্দু আর তাদের ধর্মে হল হিন্দু।স্বামী বিষ্ণু বলেনযিনি বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় নিষ্ঠাবান,গোবৎস বেদকে মাতৃতুল্য মনে করেন, দেবমূর্তিকে অবজ্ঞা করেন না,সকল ধর্মকে সমাদর করেন,পুনর্জন্মে বিশ্বাসী,সর্বজীবকে আত্মপৎ মনে করেন,তিনিই হিন্দু।

Oxford Dictionary তে বলা হয়েছে,The main religion social system of India, which meludes the worship of several Gods and in reincarnation. [Hinduism]

Encyclopedia of Britannica তে বলা হয়েছে,The name of Hinduism means the civilizations of the hindu. Originally the inhabitants of the land of the land of Indus rivers.

Xxxxx

উনবিংশ শতকে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদীগণ ‘হিন্দু-ইজম’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু করার পর থেকেই হিন্দুধর্ম একটি বিশ্বধর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।এছাড়াও শব্দটির প্রাথমিক প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ বা ‘প্রথম যুগের ভারততত্ত্ববিদগণ’, যাঁদের বক্তব্য সাধারণত একপেশে ছিল বলে মনে করা হয়। যদিও হিন্দুধর্মের শিকড় ও তার বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার প্রাচীনত্বের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। সকলেই স্বীকার করেছেন যে প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা থেকে ঐতিহাসিক বৈদিক সভ্যতার প্রাথমিক পর্ব জুড়ে ছিল হিন্দুধর্মের সূচনালগ্ন। কেবলমাত্র ধর্মবৈভিন্ন প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বৈদিক সংস্কারের ভিত্তিতে হিন্দুধর্মের একটি রূপ দান করেছেন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদগণ – এমন কথাও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু তা সত্য নয়।

Xxxxxx

পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে, ধর্ম কি এবং কিভাবে তা আরও প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত তারই বিচারে হিন্দুধর্মকে যাচাই করা হয়। ‘ধর্মবিশ্বাস’ (‘ফেইথ’) শব্দটি ‘ধর্ম’ (‘রিলিজিয়ন’) অর্থে প্রয়োগের ফলে এই বিষয়ে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো পণ্ডিত এবং অনেক হিন্দু দেশীয় ‘সনাতন ধর্ম’-এর সংজ্ঞাটির পক্ষপাতী।এই সংস্কৃত শব্দবন্ধটির অর্থ ‘চিরন্তন ধর্ম (বিধি)’ বা ‘চিরন্তন পন্থা।এই ধর্মের অন্যান্য নামসমূহ হল আর্য,সনাতন,বর্ণাশ্রম ও ব্রাহ্ম ইত্যাদি।

Next Post Previous Post
1 Comments
  • নামহীন
    নামহীন ১ মে, ২০২২ এ ১১:১৭ PM

    Valo

Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>