হিন্দু ধর্মে মোট কতটি দেব-দেবী রয়েছে

তিনটি ব্যাখ্যার মাধ্যমে সনাতন/হিন্দু ধর্মের কতগুলো দেবদেবী রয়েছে ও তাদের মধ্যে সবার বড় কে তা পর্যালোচনা করার চেষ্টা করা হলো -

বেদে ৩৩ ধরনের দেবতার কথা বলা হয়েছে 

ব্যাখ্যাঃ১-মনে রাখতে হবে দেবদেবীগণ ঈশ্বর নন। ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণা অর্থাৎ জগতের সব গুনের(Quality) আধার তিনি। আবার ঈশ্বর সগুনও কারণ সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর চাইলেই যে কো্নো গুনের অধিকারী হতে পারেন এবং সেই গুনের প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেন। দেব দেবীগন সেই ঈশ্বরের এই সগুনের প্রকাশ।অর্থাৎ ঈশ্বরের এক একটি গুনের সাকার প্রকাশই দেবতা। ঈশ্বর নিরাকার কিন্তু তিনি যে কোন রূপে সাকার হতে পারেন, আমাদের সামনেই কারণ, তিনি সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। যদি আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার গুনের প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক।তাই, ঈশ্বরের শক্তির সগুন রূপ।আর নির্গুণা বলতে , অগুন নয়,অসীম গুণের অধিকারী,।অবার ঈশ্বর সগুন অর্থাৎ সাকার প্রকাশ। সাস্রে ৩৩ কোটি দেব দেবীর কথা বলা হয়েছে। ৩৩টি প্রকার হলে তো অর্জুন ৩৩ টি মস্তক দেখতে পেতো বিশ্বরূপে। অর্জুন বলেছিল মস্তক শুরু এবং শেষ নেই ,যেখানে মস্তক ই ১ টি গুন বা দেবতা ,তাহলে সঠিক কয়টি দেবতা?

মন্তব্যঃ আমার মতে এটা গণনা না করে,যে কোনো গুনের জন্য অবার দেবতা হতে পারে ,কারণ ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ,নির্গুণা।


ব্যাখ্যাঃ২-আপনার প্রথমে জানা দরকার……

✔ হিন্দু বলতে কোন ধর্মই নাই।✔ কোন ধর্মের মধ্যে কোন দেব-দেবী থাকে না।তাহলে ?✔ তবে বৈদিক/সনাতন ধর্ম কে মানুষ হিন্দু ধর্ম হিসেবে জানে।✔ সনাতন ধর্মের বই গুলোতে বিভিন্ন দেব-দেবীর কথা আছে। যেমনঃ বেদ, উপনিষদ।✔ পুরাণ নামে কিছু সংখ্যক কাল্পনিক কাহিনীর বই আছে, যেগুলোকে হিন্দু ধর্মের বই মনে করা হয়, এগুলোতে বিভিন্ন কাল্পনিক দেব-দেবীর কাহিনী আছে।(১৮ টি প্রধান পুরাণ ধরা হয়, এছাড়াও আরো অনেক উপ পুরাণ আছে)।এখন আসি, আসল কথায়….

➤ বেদ এ ৩৩ টি/ ৩৩ ধরনের দেবতার কথা উল্লেখ আছে। এদের মধ্যে কিছু দেবতাকে দেখা যায় অথবা অনুভব করা যায়, বাকিগুলোকে দেখা যায় না, তবে ব্য্যাখা জানলে বোঝা যায়। যেমনঃ সূর্য, অগ্নি, ইন্দ্র, পৃথিবী, আলো, বায়ু, পানি ইত্যাদি।

➤ দেবতাদের মধ্যে কোন ছোট বা বড় নেই। দেবতা এবং দেবী একই জিনিস। এরা সবাই সৃষ্টিকর্তার/ ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ মাত্র।

নিচের ছবিটিতে দেখুন কিছুটা বুঝতে পারবেন।এবার আসি পুরাণের কথায়….

Surya means sun vedic
Surya means sun vedic 

Surya means sun
Surya means sun

☞ কাহিণীতে দেব-দেবীর হিসাব থাকে না। দু-চারটা ও হতে পার, হাজার হাজারও হতে পারে।

কিছু কাল্পনিক দেব-দেবীর ছবির উদাহরণঃ

Puranic Dev-devi League
Puranic Dev-devi League
Moha Krishna/Vishnu (বিষ্ণু/কৃষ্ণের বিশ্বরুপ)
Moha Krishna/Vishnu (বিষ্ণু/কৃষ্ণের বিশ্বরুপ)

মহা দুর্গা (দুর্গার বিশ্বরুপ)
মহা দুর্গা (দুর্গার বিশ্বরুপ)

Durga Devi (দুর্গা)
Durga Devi (দুর্গা)

Kali Devi (কালী)
Kali Devi (কালী)

☞ আর যার কাহিণী একটি বইয়ে লিখা হবে, সে অবশ্যই সেই কাহিণীতে প্রধান চরিত্র।

আপনি নিশ্চই সুপারম্যান এর কাহিনীতে আয়রন ম্যান কে প্রধান চরিত্র হিসেবে লিখবেন না।

[Note: Of course you can do anything you want, it's a free world]

নিচের ছবি গুলো দেখুন, আর একটু চিন্তা করুন, কিছুটা হলেও বুঝতে পারার কথা।

বিষ্ণু শিবের পুজা করতেছে
বিষ্ণু শিবের পুজা করতেছে

বিষ্ণু শিবকে সৃষ্টি করতেছে। (বামে বিষ্ণু)
বিষ্ণু শিবকে সৃষ্টি করতেছে। (বামে বিষ্ণু)


শিব সৃষ্টি হওয়ার পর বিষ্ণুকে প্রনাম দিচ্ছে।
শিব সৃষ্টি হওয়ার পর বিষ্ণুকে প্রনাম দিচ্ছে।


শিব সহ বাকি দেবতা বিষ্ণুর পুজা করতেছে
শিব সহ বাকি দেবতা বিষ্ণুর পুজা করতেছে


শিব (উজ্জল আলো রুপে) ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে সৃষ্টি করেছে, বলতেছে।
শিব (উজ্জল আলো রুপে) ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে সৃষ্টি করেছে, বলতেছে।


বিষ্ণু ও ব্রহ্মা (বামে বিষ্ণু) সৃষ্টি হওয়ার পর, শিবকে প্রণাম দিচ্ছে ও আদেশ মান্য করতেছে।
বিষ্ণু ও ব্রহ্মা (বামে বিষ্ণু) সৃষ্টি হওয়ার পর, শিবকে প্রণাম দিচ্ছে ও আদেশ মান্য করতেছে।

বিষ্ণু শিবের গলা চিপে ধরেছে। (বামে বিষ্ণু)
বিষ্ণু শিবের গলা চিপে ধরেছে। (বামে বিষ্ণু)


বিষ্ণু এবং শিব যুদ্ধ করতেছে। (বামে বিষ্ণু, ডানে শিব)
বিষ্ণু এবং শিব যুদ্ধ করতেছে। (বামে বিষ্ণু, ডানে শিব)


সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বাচার সাহায্য চেয়ে, বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করতেছে। (ডানে ব্রহ্মা)
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বাচার সাহায্য চেয়ে, বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করতেছে। (ডানে ব্রহ্মা)


বিষ্ণু লক্ষীর সেবা করতেছে
বিষ্ণু লক্ষীর সেবা করতেছে



দুর্গা সৃষ্টি হওয়ার পর লক্ষীকে ভক্তি দিচ্ছে। (পাশে বিষ্ণু)

দুর্গা সৃষ্টি হওয়ার পর লক্ষীকে ভক্তি দিচ্ছে। (পাশে বিষ্ণু)

লক্ষী দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করতেছে। (পাশে বিষ্ণু)
লক্ষী দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করতেছে। (পাশে বিষ্ণু)


লক্ষী বিষ্ণুর সেবা করতেছে।
লক্ষী বিষ্ণুর সেবা করতেছে।


লক্ষী বিষ্ণুর সেবা করতেছে।
      লক্ষী বিষ্ণুর সেবা করতেছে।

             

ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত হাবি জাবি উদাহরণ আছে।

মানুষ যখন দেবতা বা দেবী নিয়ে কোন কাহিনী লিখা শুরু করে, তখন সাধারণ দেবতা ও দেবীকে মানুষের মত করে কল্পনা করে কাহিনী লিখে থাকে। তাই মানুষ দেখতে যেমন, দেব-দেবীরাও অনেকটাই সেইরকমই হয়, আবার অন্য রকমও হতে পারে, মানুষ যেমন অস্ত্র, পোশাক ব্যবহার করে, দেব-দেবীদেরকেও সেইভাবেই ডিজাইন করে থাকে। সেই সাথে মানুষ যেমন অকাম কুকাম করে, সেইভাবে দেব-দেবীরাও কাহিনীতে করে থাকে, এভাবেই সকল পুরাণ কাহিনী লিখা হয়েছে।

আর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছিনা, কারণ এইসব কাহিনীতে দেব-দেবীরা এমন কিছু অকাম কুকাম করেছে, যেগুলো বলার মত না।অবশ্য এই সব পুরাণ কতকগুলো লেখকের চিন্তাধারা ও কল্পনার লিখিত রুপ মাত্র। তাই সিরিয়াস ভাবে নেয়ার কোন দরকার নেই।তাই,বিষ্ণু পুরাণে বিষ্ণুই প্রধান।শিব পুরাণে শিবই প্রধান।দেবী পুরাণে দুর্গাই প্রধান। ইত্যাদি ইত্যাদি হাবি জাবি আরকি……………..।আর আমার কাহিনীতে আমিই সবচেয়ে প্রধান, আমিই সবচেয়ে বড় দেবতা, তাই আমিই সব।

ব্যাখ্যাঃ৩-দেবতা কি জিনিস আগে তা জানা উচিত।দেবতার পরিচয়?,দেবতার স্বরুপ কি?

নিরুক্তি দিয়ে দেবতার পরিচয় শুরু করি,কেননা 'দেব' শব্দটি যৌগিক এবং পারিভাষিক।আর বৈদিক সাহিত্যে এমনতর শব্দের ব্যবহার সুপ্রচুর বলে তাদের তাৎপর্য নির্ণয়ে নিরুক্তি একটা প্রধান অবলম্বন।'দিব' থেকে 'দেব'।কিন্তু বেদে প্রাতিপাদিকরুপেই দিব এর ব্যবহার আছে,ধাতুরুপে নাই।তার জায়গায় আছে 'দী' ধাতু অর্থ 'দীপ্তি দেওয়া,ঝলমল করা'।প্রাতিপাদিক 'দিব' দ্যুলোক,আলোঝলমল আকাশ।আকাশে যতক্ষণ আলো আছে,ততক্ষণ 'দিব্য'।দিব্ দিবা দেব তিনটি শব্দে একই ভাবনার প্রকাশ।সে-ভাবনার আলোর।অতএব দেবতার স্বরুপ হল আলো।বাইরে যা আলো,অন্তরে তা-ই 'বোধ' বা জেগে ওঠা,'চিত্তি' বা বিবেক;তার ফলে প্রজ্ঞান,সংজ্ঞান ও সংবিৎ।এমনি করে সাধ্য দেবতা সাধকের আত্মভূত হন।দেবতার একটি সাধারণ সংজ্ঞা বসু অর্থ দীপক,জ্যোর্তিময়।সংহিতায় দেবতার প্রধান বিভূতি অগ্নি ইন্দ্র সোম রুদ্র মরুদগণ ঊষা সূর্য পূষা আদিত্যগণ সবাই বসু।ঊষা আর বসু একই ধাতু হবে ব্যুৎপন্ন।বিশ্বদেবগণও সাধারণভাবে বসু।আবার বসুরা একটি দেবগণ,সংহিতায় তাঁদের বহু উল্লেখ আছে।ধনবাচী ক্লীবলিঙ্গ বসু শব্দও সামান্যত আলোকবিত্তকেই বোঝায়।বসু বলেই দেবতা 'বসিষ্ঠ' বা জ্যোতিষ্মত্তম,'বিবস্বান' বা আলোক ঝলমল।অনুভবের দিক দিয়েও দেবতা 'জ্যোতিঃ'।বেদে এই শব্দটি বহুপ্রযুক্ত।ব্যুৎপত্তিতে 'দেব' আর জ্যোতিঃ' সগোত্র।বাইরে জ্যোতির সর্বোত্তম প্রকাশ সূর্যে।ঋকসংহিতা সর্বানুক্রমণীকার কাত্যায়ন বলেন,'অথবা এক মহান আত্মাই দেবতা,তাঁকে বলা হয় সূর্য।তিনিই সর্বভূতের আত্মা।তাই ঋষি বলছেন,যা কিছু চলছে যা কিছু স্থির হয়ে সেসবার আত্মা সূর্য।তারই বিভূতি হলেন অন্য দেবতারা।সেকথাই এই ঋকে বলা হয়েছে:(পক্ষবান দিব্য সুপর্ণ যিনি)তাঁকেই তাঁরা বলছেন ইন্দ্র মিত্র বরুণ আর অগ্নি;(এক সৎকেই বিপ্রেরা বহু ভাবে প্রকাশ করছেন বলছেন অগ্নি যম আর মাতরিশ্বা)।দেবতার জন্য আর্যহৃদয়ের যে আকুতি তা এই জ্যোতির আকুতি।বসিষ্ঠ বলেন:আর্যের লক্ষণ,জ্যোতিকে তাঁরা করেছেন তাঁদের অগ্রগামী।আদিত্যায়নের ছন্দে তাঁদের জীবনায়ন,আলোর পিপাসা তাঁদের অগ্রগামী।আদিত্যায়নের ছন্দে তাঁদের জীবনায়ন,আলোর পিপাসা তাঁদের দিশারী।ঋষি গৌরবীতির হৃদয়তন্ত্রে তাই তীব্রনিঃস্বনে ঝঙ্কৃত হতে শুনি এই ঋক;'অপ ধ্বান্তম ঊর্ণুহি পূর্ধি চক্ষুর মুমুগ্ধ্য অস্মান নিধয়ের বদ্ধান' হে দেবফা অপাবৃত কর এই অন্ধকার,ভরে দাও এই চোখ আলোতে,মুক্ত কর আমাদের পাশে বদ্ধ হয়ে রয়েছি যে!আবার জীবণের প্রাচীমূলে উষার আলোয় প্রাতিসংবিতের আভা যখন ফোটে,ঋষি কুৎসের কণ্ঠে তখন শুনি উদ্বোধিনী বাণীর এই উল্লাস: 'ওঠ উদ্যত কর নিজেদের! যা আমাদের জীবন যা আমাদের প্রাণ,তা-ই এসেছে।দূরে চলে গেল অন্ধকার,এই যে আলো আসছে।খুলে দিল সূর্যের যাত্রার পথ।সেইখানে পৌঁছলাম আমরা,যেখানে সবার আয়ুর প্রতরণ।'দেবতারা 'সুজ্যোতিঃ' তমঃ হতে জ্যোতিতে উত্তরণই জীবণের দিব্য নিয়তি।ঋকসংহিতা হতে এই জ্যোতির্ভাবনার অনুকূল কিছু মন্ত্রের উদ্দেশ ও আলোচনায় আশা করি দেবতার স্বরুপের পরিচয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে।আগেই বলেছি,অধ্যাত্মসিদ্ধির একটি প্রতিচ্ছবি আছে সূর্যোদয়ে,অন্ধকার হতে আলোর উৎসারণে।দেবতা আকাশে সূর্যকে ফুটিয়ে তোলেন,একথার উল্লেখ পাই বহু মন্ত্রে।বাইরে যা ভূতাকাশ,অন্তরে তা-ই চিদাকাশ;সেখানে সূর্যোদয়ই উপাসকের পরম আকাঙ্ক্ষিত।দেবতা তার সে আকাঙ্ক্ষাকে সার্থক করেন।'তাঁর জ্যোতি দিয়ে তমিস্রার কুহর হতে কিরণরাজিকে দোহন করে উৎসারিত করেন।'যে তমঃ বৃত্র হয়ে উপাসকের চেতনাকে আবৃত করে রেখেছে,তাকে দেবতা নির্জিত করেন জ্যোতি দিয়ে(জ্যোতিষা)।অগ্নি জন্মেই ঝলমলিয়ে ওঠেন,নিহত করেন দস্যুদের,জ্যোতি দিয়ে তমিস্রাকে করেন অপসারিত,খুঁজে পান কিরণ প্রাণ এবং সূর্যকে;তমিস্রা হতে নির্গত হয়ে আসেন তিনি জ্যোতি নিয়ে;অথবা ঋষির মত দিব্য জ্যোতি দিয়ে তিনি যেন পুড়িয়ে মারেন সেই অবিবেকীকে,সত্যকে যে করে বিকৃত;দ্যাবাপৃথিবীর অন্তরালে আছে যে-তমিস্রা,বৈশ্বানররুপে তাকে তিনি নিরাকৃত করেন জ্যোতি দিয়ে।উষা যেমন অরুণ আলোয় রাত্রিদের করেন অপাবৃত,নিরাকৃত করেন জ্যোতি দিয়ে।উষা যেমন অরুণ আলোয় রাত্রিদের করেন অপাবৃত,তেমনি মরুদগণ অন্ধকারকে অপাবৃত করেন দুধের ঢেউখেলানো জ্বলজ্বলে জ্যোতির মহিমা দিয়ে।বিশ্বের নায়ক ইন্দ্র দ্যাবাপৃথিবীকে ছেয়ে আছেন জ্যোতি দিয়ে,যে তমিস্রা হটানো কঠিন তাকে গুটিয়ে এনেছেন সীবন করে;গুহার অন্তরালে ছিল যে পয়স্বিনী আলোকধেনুরা তাদের হাঁকিয়ে বের করলেন তিনু,একসঙ্গে সংবৃত অন্ধকারমে জ্যোতির দ্বারা করলেন বিবৃত।শোভনা নারীর মত তাঁর তনুকে জানেন উষা,উন্নতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই যে আমাদের দৃষ্টির সামনে স্নানরতা,বিদ্বেষীদের তমিস্রাদের অভিভূত করে দিবোদুহিতা এসেছেন জ্যোতি নিয়ে;দেবী উষা চলেছেন জ্যোতি দিয়ে পরাভূত অপসারিত করে যত অন্ধকার যত দুরিত;এই যে তিনি জেগেছেন নতুন জীবণ আহিত করে,তমিস্রাকে জ্যোতি দিয়ে নিগূহিত করে এগিয়ে চলেছেন অকুণ্ঠিতা যৌবনবতী,প্রচেতনা এনেছেন সূর্যের যজ্ঞের অগ্নির।যে সূর্য স্থাবর-জঙ্গমের আত্মা,তিনি যেন দূরে হটিয়ে দেন আমাদের যত তেজোহীনতা অনাহুতি অস্বাস্হ্য আর দুঃস্বপ্ন তাঁর সেই জ্যোতিতে যা তমিস্রাকে তিনি করেন অভিভূত,যে প্রভায় বিশ্বজগৎকে করেন উদ্যত।পৃথিবীতে অগ্নি সেই জ্যোতি,মনু যাঁকে নিহিত করেছেন বিশ্বজনের জন্য;তিনি পুঞ্জীভূত জ্যোতি,বৃহজ্জ্যোতি,মহাজ্যোতি-দেবতারা তাঁর জন্ম দিয়েছেন 'চিত্তি' বা বিবেক দিয়ে;আবেগকম্প্র বাণীর মধ্যে যে জ্যোতির উল্লাস,তিনি তার ভর্তা।অন্তরিক্ষে,দ্যুলোকের উপান্তে ইন্দ্র সেই আদিতু যিনি উপাসককে উত্তীর্ণ করেন সেই বিশাল অভয়জ্যোতিতে যেখানে দীর্ঘ তমিস্রা আর তাদের নাগাল পায় না।অন্ধতমসের মধ্যে যে-জ্যোতি তিনি ফুটিয়ে তোলেন যজমানের জন্য,তা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না;এই জ্যোতিরুচ্ছ্বাস তিনি আহরণ করেন তারই জন্য যে প্রাণ আর মনের সাধক;আঁধারের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি ফোটান জ্যোতি,নিয়ে চলেন আরও আলোর পানে।তারপর দ্যুলোকে আছে অশ্বিদ্বয়ের জ্যোতিঃ;তাঁরা জ্যোতি ফোটান বিশ্বজনের জন্য,আর্যের জন্য,প্রবক্তা বিপ্রের জন্য।আছে উষার জ্যোতিঃ সুন্দরূ উষা জ্যোতি ফোটান;তিনি ঝলমলিয়ে ওঠেন যখন,তখন দেখি বিশ্বের প্রাণ আর জীবন তাঁরই মধ্যে;সমস্ত জ্যোতির শ্রেষ্ঠ জ্যোতি তিনি;দিবোদুহিতা তিনি জ্যোতির বসন পরা;অঙ্গে অঙ্গে বিচিত্র বর্ণের পসরা ছড়ান নর্তকীর মত,আদুর করে দেন বুকখানি,বিশ্বভুবনের জন্যে জ্যোতি ফুটিয়ে অপাবৃত করেন তমিস্রা;এই-যে সেই পূর্ণতম জ্যোতি চোখের সামনে তমিস্রা হতে জেগেছে পথের নিশানা নিয়ে,এই যে দিবোদুহিতা উষারা ঝলমলিয়ে পথ করে দিলেন জনগণের জন্য;এই যে দিবোদুহিতা মানুষের সামনে এসে কল্যাণী নারীর মত ঝরান রুপের ধারা....আবার আগেরই মতন যৌবনবতী ফোটান জ্যোতি;তাঁর আলোকধেনুরা তমিস্রাকে গুটিয়ে আনে,জ্যোতিকে উদ্যত করে সবিতার দুটি বাহুর মত;অরুণবর্ণা উষা দেখা দিলেন,ফোটলেন জ্যোতি ঋতম্ভরা।আছে সূর্যের জ্যোতিঃ আপূরিত করেছেন দ্যাবাপৃথিবী আর অন্তরীক্ষ সূর্য তাঁর রশ্মি দিয়্র চিন্ময় হয়ে সূর্য জ্যোতিঃস্বরুপ,চলছেন অপরুপ আয়ুধ হয়ে;স্বমহিমায় দেবতাদের অসূর্য পুরোহিত তিনি,তিনি সেই বিভু জ্যোতি যাকে প্রবঞ্চিত করতে পারে না কেউ;মহাজ্যোতি বয়ে আনেন তিনি সর্বদর্শী,ঝলমল,প্রতি নয়নের আনন্দ;অজর নক্ষত্র তিনি সর্বজনের জ্যোতি;দ্যুলোকের ধর্মে ও ধুতিতে নিবেশিত অসুরঘাতী শত্রুঘাতী জ্যোতি তিনি;ইনি জ্যোতিঃসমূহের শ্রেষ্ঠ ও উত্তম জ্যোতি,ইনিই বিশ্বজিৎ ধনজিৎ,একেই বলে বৃহৎ,ইনিই এই বিশ্বভূবনকে ধরে আছেন বিশ্বকর্মা হয়ে,বিশ্বদেবতার মহিমায় ইনি বধু জ্যোতির এর আবরণ জরায়ুর মত;ইন্দ্র যখন অহিরুপী বৃত্রকে বধ করেন তাঁর প্রাণোচ্ছ্বাসে,তখনই এই সূর্যকে দ্যুলোকে আরূঢ় করান দর্শনের জন্য;সূর্য আত্মা যা চলছে তার,যা স্থির আছে তারও।আছেন অদিতির পুত্রেরা যাঁরা জীবণের জন্য অজস্র জ্যোতি দেন মর্তামানবকে।আছে সোম্য জ্যোতি,যাকে লাভ করাই যাজ্ঞিকের পরম পুরুষার্থ:সোম দেন শাশ্বত জ্যোতি,শাশ্বত সৌরদীপ্তি....আমাদের করেন আরও জ্যোতির্ময়;তাঁর ধারা জ্যোতি আহরণ করে আমাদের জন্য;পরিশোধিত হতে-হতে জন্ম দেন তিনি দ্যুলোক হতে সুদর্শন বজ্রের মত বৈশ্বানর বৃহৎ জ্যোতি;জন্ম দেন তিনি ঋতকে বৃহৎকে শুক্লজ্যোতিকে কৃষ্ণ তমিস্রাদের মরণ হেনে-হেনে;তাঁর রস সমর্থ হয়ে বিরাজ করে ঝলমলিয়ে বিশ্বজ্যোতীরুপে সূর্যের দর্শনের জন্য;তা-ই তো তাঁর সত্য যে দিনের জন্য তিনি রচলেন জ্যোতি আর লোকের বৈপুল্য;বিপ্যল জ্যোতি রচেন তিনি,মাতিয়ে তোলেন দেবতাদের;ইন্দ্রে তিনি আহিত করেন ওজস্বিতা,সূর্যের মধ্যে জ্যোতির জন্ম দেন ইন্দু হয়ে;জ্যোতিরা তাঁরই,তাঁরই সূর্য;আদিম তিনি,আমাদেরই জন্য ঝলমলিয়ে তোলেন জ্যোতিদের;দিন তিনি আমাদের শান্তি মহাভূমি আর জ্যোতিদের,দীর্ঘকাল আমাদের দিন সূর্যকে-দেখবার জন্য।আবার,যে আলোকধেনুরা গোপন রয়েছে অনৃতের বন্ধনে,তমিস্রার মধ্যে জ্যোতির অন্বেষণেব বৃহস্পতি সেই আলোকময়ীদের উদ্বৃত করলেন নীচের দুটি আর উপরের একটি দুবার দিয়ে-তিনটিকেই করলেন বিবৃত।তাহলে দেখতে পেলাম,জ্যোতিই দেবতার স্বরুপ,অন্ধকার হতে জ্যোতির উৎসারেই তাঁদের বৈভবের পরিচয়।এই জ্যোতি আমাদের নিত্যকাম্য;এ যেমন পরমব্যোমে মহাজ্যোতি,তেমনি দেবকামের সমিদ্ধ অগ্নিতে বিপুল জ্যোতি,ইন্দ্রপ্রদিষ্ট সৌরদীপ্তিময় অভয় জ্যোতি।এ সেই প্রথম বীজের ঝলমল জ্যোতি,আধারে যা নিগূঢ় হয়ে রয়েছে-সত্যমন্ত্র পিতারা যাকে পেয়ে উষার জন্ম দিয়েছেন।জ্যোতির অন্তরে এই জ্যোতি তিনটি আবর্তে উঠে গেছে উপরপানে হয়েছে দ্যুলোকে নিত্যজাগ্রত সেই উত্তম জ্যোতি যা তমিস্রার ওপারে উত্তরজ্যোতিকেও ছাপিয়ে গেছে।এই জ্যোতি হতে প্রবাসী হতে আমরা চাই না।ডান বা বাঁ আমরা চিনি না,সমুখ বা পিছনও চিনি না;মূঢ়তাতেই হক আর ধীরতাতেই হক,সেই অভয় জ্যোতির সম্ভোগ আমরা চাই,আলোর দেবফা আদিত্যেরা যা আমাদের কাছে নিয়ে আসবেন।বেঁচে থাকতেই আমরা যেন জ্যোতির আস্বাদ পাই।এই জ্যোতি সবার জন্য:বৈশ্বানররুপী এই দেবতাকে এই জ্যোতিকে দেবতারা জন্ম দিয়েছেন আর্যের জন্য;ইন্দ্র এই আর্য জ্যোতিকে এই সৌরদীপ্তিকে খুঁজে পেয়েছেন মনুর জন্য;বিশ্বজনীন এই অমৃত জ্যোতি,বিশ্বমানবের দেবতা সবিতা একে আশ্রয় করে উদিত হয়েছেন।এই জ্যোতি সর্বত্র:হংসরুপে এই জ্যোতি নিষণ্ণ আছেন শুচিতে,আলোরুপে অন্তরিক্ষে,হোতৃরুপে বেদিতে,অতিথিরুপে দ্রোণে;নিষণ্ণ রয়েছেন নরের মধ্যে,বরেণ্যের মধ্যে,ঋতের মধ্যে,ব্যোমের মধ্যে;জন্মেছেন তিনি অপ হতে গো হতে ঋত হতে অদ্রি হতে;তিনি ঋত এবং বৃহৎ।অগ্নির মধ্যে এই বিশ্বরুপ বৈশ্বানর জ্যোতিকে প্রত্যক্ষ করে ঋষি ভরদ্বাজ বলছেন: এই যে প্রথম হোতা,একে তোমরা চেয়ে দেখ।মর্ত্যের মধ্যে ইনিই অমৃত জ্যোতি।এই যে তিনি জন্মেছেন,ধ্রুব-রুপে এই যে নিষণ্ণ তিনি অমর্ত্য হয়ে তনুর সঙ্গে বেড়ে চলেছেন।ধ্রুব জ্যোতিরুপে নিহিত তিনি সবস্র মধ্যে-দেখা দেবেন বলে;যারা উড়ে চলে তাদের মধ্যে মন তিনি দ্রততম।বিশ্বদেবতারা এক মন এক চেতন্স নিয়ে এক ক্রতুর পানে চলেছেন সুচ্ছন্দে ল।উড়ে চলুক আমার দুটি কান,উড়ে চলুক চোখ,উড়ে এই জ্যোতি-হৃদয়ে যা আহিত।আমার মন যে বিচরণ করছে সুদুরের ভাবনায়:কীই বা বলন আমি,কীই-বা ভাবব?বিশ্বদেবতারা প্রণাম করলেন ভয়ে-ভয়ে তোমায় হে অগ্নি,তমিস্রার মধ্যে ছিলে যখন।বৈশ্বানর আমাদের আগলে থাকুন কল্যাণের জন্য,অমর্ত্য আমাদের আগলে থাকুন কল্যাণের জন্য।এই জ্যোতির সাধন বাইরে যেমন যাগ,অন্তরে তেমনি যোগ:মনন আর জ্যোতির প্রজ্ঞান হয় হৃদয় দিয়ে...দ্যুলোক আর ভূলোকের সব তখন দেখা যায়।মনকে ধরে রেখেছে যে-সুকর্মারা,তারাই দ্যুলোকক্র রুপ দেয় ত্বষ্টার মত।জ্যোতিকে তারা পায়,ধ্যান দিতে তাকে রুপ দিতে চায় যখন।আমাদের প্রতি তাই এই আর্য অনুশাসন:যজ্ঞের তন্তুকে বিতত করে অনুসরণ কর প্রাণ লোকের ভাতিকে;ধ্যান দিয়ে রচেছ যে জ্যোর্তিময় পথ,আগলে রাখ তাদের।গ্রন্থি না পড়ে এমনি করে বয়ন কর গায়কদের কর্ম।মনু হও,জন্ম দাও দিব্য জনকে।কেননা,আমাদের পিতৃপুরুষরা ধ্যান করে করেই বিপুল জ্যোতিকে পেয়েছিলেন।আর তাই আমরা বলতে পারি:আমরা পান করেছি সোম,আমরা অমৃত হয়েছি;আমরা গিয়েছি জ্যোতিতে,পেয়েছি দেবতাদের।এই ব্রহ্মঘোষেই জ্যোতিরেষণার পরিসমাপ্তি।দেবতার স্বরুপ জ্যোতি।আকাশের সূর্য তার প্রতীক।সূর্যের যেমন আলো আছে,তেমনি আছে তাপও।আলো প্রকাশ করে,তাপ বা তপঃ সৃষ্টি করে।অধ্যাত্ম-দৃষ্টিতে একটি প্রজ্ঞা,আরেকটি শক্তি।একটি থেকে আরেকটিকে পৃথক করা যায় না।আবার সূর্য আদিত্য কিনা অদিতির পুত্র।অদিতি সংজ্ঞার অর্থ অখণ্ডিতা,অবন্ধনা।তিনি অনন্ত্যস্বরুপিণী,আকাশ তার প্রতীক;তাঁর কথা পরে বলছি।আকাশে আদিত্য জ্যোতি এবং তাপ বিকিরণ করছেন-দেবতার এই প্রত্যক্ষদৃষ্ট বৈভব বৈদিক অধ্যাত্মভাবনার উদ্দীপক।আকাশ জ্যোতি এবং তপ এই তিনটি ভাবনাই একান্তভাবে দেবভাবনার সহচরিত।জ্যোতির কথা বলেছি,এখন আকাশের কথা বলছি।ঋকসংহিতায় আকাশের দুটি সংজ্ঞা প্রধান একটি 'দিব্' আরেকটি 'র‍্যোমন্'।প্রথমটিতে রুপের দ্যোতনা আছে,দ্বিতীয়টিতে নাই-আছে শুধু ব্যপ্তি আর তুঙ্গতার ইশারা।সংহিতায় লোক বা চেতনার ভূমির সাধারণ সংজ্ঞা 'রজঃ'।ব্যোম তারও ওপারে,অর্থ্যাৎ ব্যোম লোকোত্তর।প্রায় সর্বত্র শব্দটির সঙ্গে পরম বিশেষণ দেওয়া আছে।পরম ব্যোম তাহলে সেই লোকোত্তর মহাশূন্যতা যার ওপারে আর কিছুই নাই।তাই এ আবাত প্রথম ব্যোম যা দেবতাদের সদিন;পূর্ব্য ব্যোম,যেখানে তিনবার করে সোমের জন্য সপ্ত ধেনুরা ক্ষরণ করে সত্য আশীঃ।পরম ব্যোমে প্রত্ন পিতার পদ বা ধাম।সেই অক্ষর পরম ব্যোম যেখানে বিশ্বদেবেরা নিষণ্ণ আছেন,ঋকেরা সেইখানেই আছে;সেই পরম ব্যোমেই গৌরী বাক্ সহস্রাক্ষরা।এই পরম ব্যোমে মিত্র-বরুণ রয়েছেন সত্যধর্মা হয়ে,এইখানেই মহাজ্যোতি হতে বৃহস্পতির জন্ম সবার প্রথমে,জন্মেই ইন্দ্রের সোমপান এইখানেই মহাজ্যোতি হতে বৃহস্পতির জন্ম সবার প্রথমে,জন্মেই ইন্দ্রের সোমপান এইখানে,এইখানে বিশ্বভূবনের জনক বৈশ্বানরের জন্ম।এই পরম ব্যোমে ইন্দ্র রোদসীকে ধরে আছেন,ভগ যেমন ধরে আছেন তাঁর দুই পত্নীকে।বিশ্বভূবনের অধ্যক্ষ যিনি,তিনি আছেন পরম ব্যোমে;এইখানেউ বিশ্বদেবেরা স্বরাট ইন্দ্র আর সম্রাট বরুণের মধ্যে ওজ এবং বল আধান করছেন।অপ্সরা তরুণী হেসে হেসে বধুকে নিয়ে যান পরম ব্যোমে।পরম ব্যোমেই যজ্ঞের শক্তি বা সার্থক পরিণাম,ইষ্টাপূর্তেরও;যে যঘ ভূবনের নাভি,তার অধিষ্ঠাতা ব্রহ্মা যিনি,তিনিই বাকের পরম ব্যোম।এককথায় অসৎ আর সৎ দুইই এই পরম ব্যোম চেতনার তুঙ্গতম ভূমি।ঋকসংহিতায় আরও পরিচয় পাই 'অনিবাধ' 'উরুলোক' এবং 'বৃহতের' ভাবনায়।বিশ্বদেবগণের উদ্দেশে অত্রির আকুতি: হে দেবগণ,আমরা যেন বিপুল অনিবাধে থাকতে পারি।অনিবাধের বিপরীত একটি সংজ্ঞা হল সবাধ,সাধারণভাবে বোঝায় ঋত্বিককে: ব্যুৎপত্তিলভ্য অর্থ হল যার মধ্যে বাধ বা চেতনার সঙ্কোচ আছে।বাধ হতে অনিবাধে বা চেতনার বৈপুল্যে উত্তীর্ণ হওয়াই উপাসকের পরম পুরুষার্থ।ঋতের যোনিতে বা পরম অব্যক্তে(শিশুরুপে) শুয়ে আছেন যে অগ্নি এই ঘরকে ভালবেসে,তিনি মহান হয়ে বিপিল অনিবাধে বেড়ে চলেছেন।পৃথিবীর অগ্নির মত আকাশের সূর্যও অনিরুদ্ধ অনিবদ্ধ কি করে যেন তিনি হেটমুণ্ডে নেমে আসছেন না,কে দেখেছে কোন স্বপ্রতিষ্ঠায় তিনি চলেন,দ্যুলোকের সংহত স্তম্ভ হয়ে রক্ষা করছেন তারও উত্তর লোককে।তিনটি মন্ত্রের মধ্যেই মহাব্যোমে চেতনার বিস্ফারণ ও স্বচ্ছন্দ সঞ্চরণের ব্যঞ্জনা আছে।অবাধিত চেতনায় স্ফুরিত হয় লোক কিনা আলোকের ভূবন।স্বভাবত সে লোক পরিব্যাপ্ত বা বিপুল,কেননা ছড়িয়া পড়া আলোকের ধর্ম।তাই তার পারিভাষিক সংজ্ঞা উরুলোক।যে কল্যাণকৃৎ,অগ্নি তার জন্য রচেন আনন্দন উরুলোক;বৃহতের ভাবনায় বর্ধিত হয়ে তাঁর সঙ্গে তাকে রচেন সোমও-যজ্ঞের জন্য।যে ইন্দ্র আমাদের সখা,পিতা,পিতৃগণের মধ্যে পিতৃতম,তারুণ্যের বিধাতা যিনি,এই উরুলোক রচেন তিনি উতলা যজমানের জন্য-সুসবনকৃৎ বীরের জন্য তাঁকেই যে চায় তার জন্য,সহজে যে দেয় তাহা তার জন্য,তৃৎসুদের জন্য।বৃত্র বা আঁধারের আবরণ বিদীর্ণ করে তিনি রচেন এই আলোর ভুবন,অমিত্রশীল জনকে অপনোদিত করে রচেন দেবতাদের জন্য।তাঁর সোম্য মত্ততা বীর্যবর্ষী,স্পর্ধার অভিভাবী,এই উরুলোকের রচয়িতা।আবার ইন্দ্র বিষ্ণুকে,সোমমে,বরুণকে নিয়েও এই ভুবন রচনা করেন।দেবতাকে ডাকলে পরে যে বৃহস্পতি আমাদের মত লোকের জন্যও রচেন আলোর ভুবন,তিনি বৃত্রকে হনন করে বিদীর্ণ করেন তার পুরী,জয় করেন শত্রুদের,অমিত্রদের স্পর্ধাকে করেন অভিভূত।পবমান সোম দিনের জন্য ফোটান জ্যোতি আর লোকের বৈপুল্য।এই উরুলোক চাই জীবনে,পাই যেন মরণেও।চেতনার আকাশবৎ অনিবাধ বৈপুল্যের আরেক সংজ্ঞা হল বৃহৎ।শব্দটি ক্লীবলিঙ্গে ব্যবহার করা হয়।ঋতং বৃহৎ ঋকসংহিতায় একটি পারিভাষিক পদগুচ্ছ ,বোঝায় ছন্দ এবং বৈপুল্য একাধারে।এটি পরম তত্ত্বের ব্যঞ্জনবাহী।অগ্নি যে দেবগণের যজন করেন,তা এই ঋতং বৃহৎ এরই যজন,অথবা তিনি নিজেই ঋতং বৃহৎ।সূর্যও তসি।আবার সোমও তাই।এই পবমান সোম যে শত্রুজ্যোতির জন্ম দেন,তা ঋতং বৃহৎ,তা-ই দিয়ে কৃষ্ণ তমিস্রাকে তিনি হনন করেন।সমুদ্র পার হয়ে চলেন তিনি ঢেউএ-ঢেউএ-জ্যোর্তিময় রাজা তিনি ঋতং বৃহৎ;ছুটে চলেন মিত্র আর বরুণের ধর্ম মেনে-যখন প্রচোদিত হন তিনি ঋতং বৃহৎ।সহস্রধার বীর্যবর্ষী তিনি,পয়োবর্ধম,দেবজাতির প্রিয়;ঋত হতে জাত তিনি,ঋতেই বেড়ে চলেছ্রন--জ্যোতির্ময় রাজা যিনি ঋতং বৃহৎ।এক জায়গায় বিশ্ব-দেবগণের পৃথিক উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরই মতন কিরে উল্লিখিত হয়েছে ঋতং মহৎ স্বর বৃহৎ।এই আরেকটি সংজ্ঞা লক্ষণীয়: বৃহদ্দিব (স্ত্রীলিঙ্গে বৃহদ্দিবা),যা সহজেই আলোঝলমল আকাশের বৈপুল্যকে স্মরণে আনে।লোক বা ভুবন বোঝাতে সংজ্ঞাটির কোনও প্রয়োগ পাওয়া যায় না।এছাড়া অগ্নি ইন্দ্র বৃহদ্দিব,সরস্বতী বৃহদ্দিবা,উর্বশীও ফাই।এক অজ্ঞাতনাম্নী দেবী বৃহদ্দিবা;অন্যত্র তিনি শুধু মাতা বলে উল্লিখিত হয়েছেন।সেইসঙ্গে পিতা ত্বষ্টার উল্লেখ থাকায় মনে হয় বৃহদিব্বা আদিজননীরই একটি সংজ্ঞা।আবার বিশ্বদেবগণ বৃহদ্দিব।সংজ্ঞাটি এমনি অর্থবহ যে শেষপর্যন্ত তা ঋষির নামে পর্যবসিত হয়েভহে।দেবতার সঙ্গে সাযুজ্যবোধই যে সাধনার চরন লক্ষ্য,এটি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।দেবতা বৃহৎ দ্যুলোকে বৃহৎ,মানুষেও বৃহৎ।বৃহতের এই ভাবনার নিঙ্কর্ষণ দেখি উপনিষদের ব্রহ্মবাদে।আকাশে মত অনিবাধ বৈপুল্যে বৃহৎ যিনি,তিনি ব্যাপ্ত হয়ে আছেন সর্বত্র।এইটি বোঝাতে দেবিতার একটি বিশেষ্ণ 'বিশ্বমিনব'।অগ্নি বিশ্বমিন্ব,যাকে তিনি ছেয়ে থাকেন,সে হয় নিখিল(অগ্নি) স্রোতঃসম্পদে আধার।মরুদগণ,ইন্দ্র,উষা,সবিতা,পূষা,জ্যোতির দুরারেরা,দ্যাবাপৃথিবী,বিশ্বদেবগণ সবাই বিশ্বমিন্ব।অন্তর্যামীরুপে সব মানুষের মধ্যেই তিনি,তাই দেবতা বিশ্বানর।যিনি সর্বব্যাপ্ত সর্বগত সর্বনিয়ন্তা,তিনিই সব-কিছু হয়েছেন--তিনি বিশ্বরুপ।ইন্দ্র রুপে-রুপে প্রতিরুপ হয়েছেন,তাঁর সে-রুপ চেয়ে দেখবার মত;বিচিত্র মায়ায় বহুরুপ হয়ে চলছেন তিনি।অধিষ্ঠাতাকে ঘিরে আছে সবাই;বিচিত্র শ্রীর বসন পরে চলছেন তিনু স্বয়ম্প্রভ:বীর্যবর্ষী অসুরের সেই নাম যে মহৎ;বিশ্বরুপ হয়ে তিনি অমৃতসমূহে অধিষ্ঠিত।রুপে রুপে বিচিত্র হয়েভহে মঘবস(ইন্দ্র) মায়া রচে তাঁর আপন তনুকে ঘিরে।তিনি বিশ্বভূ অর্থাৎ তিনিই এই বিশ্ব হয়েছেন।বিশেষ করে ত্বষ্টা বিশ্বরুপ;বার তাঁর পুত্রও (ত্বাষ্ট্র) বিশ্বরুপ।অর্থাৎ বিশ্বকে দেবতার আত্মসম্ভূতি বা বিসৃষ্টি দুভাবেই দেখা যেতে পারে।বিশ্বের উৎপত্তি অগ্নিস্বরুপ বৃষভ-ধেনুর একটি মিথুন হতে: এই বৃষভ বিশ্বরুপ-তিনটি তাঁ বুক,তিনটি পালান,তিনটি মুখ,শক্তিমান তিনি সবার অধিপতি,সমস্ত ধেনুর রেতোধা তিনি বহুধা প্রজাবান;এই ধেনু 'বিশ্বরুপা'-দক্ষিণা উষার রথের ধুরায় যুক্তা মাতা তিনি,তাঁর ভ্রূণ ছিল আবর্তদের মধ্যে,তিন যোজন দূরে তাঁকে দেখে বাছুরটি কেঁদে উঠল।বৃষরুপে বৃহস্পতিও বিশ্বরুপ;সোমও তাই।এককথায় সেই একই হয়েছেন এই সব-কিছু।তাঁর এই বিভূতির বর্ণনা আছে পুরুষ সুক্তে:তিনি সহস্রশীর্ষা সহস্রাক্ষ সহস্রপাৎ বিশ্বরুপ পুরুষ-কেননা বিশ্বে যত শীর্ষ যত অক্ষি যত পদ সই তাঁর;তিনিই ভূত-ভব্য এই সব-কিছু হয়েছেন,এই বিশ্বভূত তাঁর একপাদ,তাঁর ত্রিপাদ দ্যুলোকে অমৃত হয়ে আছে।দেবতা যখন আমিই এইসব হয়েছি,তখন তাঁর সঙ্গে এক হয়ে মানুষও বলতে পারে,'আমিই সব হয়েছি';অঙ্গিরারাও তাই বিশ্বরুপ।তাহলে দেখতে পাচ্ছি,জ্যোতির্ময় বৃহত্ত্বই দেবতার স্বরুপ--এই হল বৈদিক দেববাদের মূলকথা।এই দেবতা সর্বত্র আছেন,কেননা তিনিই এই সব-কিছু হয়েভহেন-যেমন বাইরে তেমনি অন্তরে।বাইরে পরাক-দৃষ্টিতে তাঁকে দেখি দেবতারুপে।আর অন্তরে প্রত্যক্-দৃষ্টিতে আত্মরুপে।ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষে যা অধিভূত,চিন্ময়প্রত্যক্ষে তাই অধিদৈবত এবং অধ্যাত্ম।যেমন,বাইরে সূর্য দেখছি:এ দৃষ্টি ব্যবহারিক।এতে রুপই দেখছি,কিন্তু রুপের মধ্যে কোনও মহিমা আবিষ্কার করছি না,তার পিছনে কোনও ভাব দেখছি না।আবার দেখছু,এই সূর্যে সেই বিশ্বতশ্চক্ষুতই চক্ষু;অথবা এই সূর্য তিনিই,যিনি স্থাবর-জঙ্গমের আত্মা:এই দৃষ্টি পারমার্থিক এবং অধিদৈবত,এ কবির দৃষ্টি।দেখছি,সেই যে প্রথম প্রকাশ,তাই আবিষ্ট হয়েছে আমার দৃষ্টিত,সেই চোখ হতেই আমার চোখ;সেই চোখ দিয়ে অন্তরেও দেখছি সূর্যের জন্ম।এ-দৃষ্টিও পারমার্থিক,এ হল ঋষির অধ্যাত্মদৃষ্টি।এমনি করে বাইরে-ভিতরে এক চিন্ময় মহিমার যে প্রত্যক্ষতা,তাই বৈদিক দেববাদের ভিত্তি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>