বেদে শ্রীকৃষ্ণের উল্লেখিত নাম

বেদে শ্রীকৃষ্ণের নাম কোথায় আছে?
বেদ শব্দটির অর্থ হচ্ছে জ্ঞান।সৃষ্টির আদিতে প্রজাপতি শ্রীব্রহ্মা সেই জ্ঞানপ্রাপ্ত হন শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে।
অথর্ববেদে -'গোপালতাপনী উপনিষদ ১/২৪' বলা হয়েছে
"যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ গাপয়তি স্ম"

কৃষ্ণঃ- ব্রহ্মা, যিনি পূর্বকালে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেন, তিনি সেই জ্ঞান সৃষ্টির আদিতে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে প্রাপ্ত হন।
নারায়ণ উপনিষদে (৪) উল্লেখ রয়েছে:ব্রহ্মণ্যো দেবকীপুত্র" অর্থাৎ "দেবকী নন্দন কৃষ্ণই হলেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান।
বেদে লীলা-পুরুষোত্তম গোপেন্দ্রনন্দনের কথা-
"অপশ্যং গোপামনিপদ্যমানমা চ পরা চ পথিভিশ্চরন্তম্।
স ধ্রীচীঃ স বিষূচির্বসান আবরীবর্তিভুবনেষ্বন্ত।।"

এক গোপাল দেখলাম তার কভূ পতন নেই,নানান  পথে ভ্রমণ করছেন কখনো নিকটে কখনো দূরে। আবার তিনি কখনো বহুবিদ বস্ত্রাবৃত,কখনো বা পৃথক্ পৃথক্ বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত। এই রূপে তিনি বিশ্বসংসারে পুনঃ পুনঃ প্রকটাপ্রকট লীলা বিস্তার করছেন। 'ঋগ্বেদ ১ম মণ্ডল, ২২ অনুবাক্ ১৬৪ সূক্ত, ৩১ঋক্'
বেদ ও কৃষ্ণ/সনাতনী আলাপন  


ঋক বেদে (কৃষ্ণ উপনিষদ) বলা হয়েছে-
ওঁ কৃষ্ণো বৈ সচ্চিদানন্দঘনঃ কৃষ্ণ আদিপুরুষঃ কৃষ্ণঃ পুরুষোত্তমঃ কৃষ্ণো হা উ কর্মাদিমূলং কৃষ্ণ স হ সর্বৈকার্যঃ কৃষ্ণঃ কাশংকৃদাদীশমুখপ্রভুপূজ্যঃ কৃষ্ণোহনাদিস্তমিন্ন জাণ্ডান্তর্বাহ্যে যন্মঙ্গলং তল্লভতে কৃতী।।
অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণই সৎ, চিদ্ ও আনন্দঘন শ্রীবিগ্রহ, শ্রীকৃষ্ণই আদি পুরুষ, শ্রীকৃষ্ণই পুরুষোত্তম, শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত কর্মের মূল, সর্বকার্যের উৎস। শ্রীকৃষ্ণ সকলের একমাত্র প্রভু, শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব ইত্যাদি ঈশ্বর প্রমুখ দেবগনের প্রভু এবং পূজ্য। শ্রীকৃষ্ণ আদিরও আদি (অনাদি)। ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরে ও বাইরে যত মঙ্গল, কৃষ্ণসেবক কৃতী ব্যক্তি সেই সমস্ত মঙ্গল শ্রীকৃষ্ণেই লাভ করে থাকেন।

শ্রীমদ্ভগবতগীতার পুরুষোত্তম যোগ অধ্যায়ে ১৫/১৫ শ্রীকৃষ্ণের উক্তি বিবৃত করেছেন-
বেদৈশ্চ সর্বেঃ অহমেব বেদ্যা বেদান্তকৃদ বেদবিদেব চাহম্।।
অর্থাৎ আমিই বেদের সমস্ত  জ্ঞাতব্য বিষয় এবং আমিই সমস্ত বেদান্ত কর্তা ও বেদবেত্তা।
মোক্ষধর্মে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
প্রজাপতিং চ রুদ্রং চাপ্যহমেব সৃজামি বৈ।
তৌ হি মাং ন বিজানীতো মম মায়া বিমোহিতৌ।।
অর্থাৎ আমি সৃষ্টি করেছি প্রজাপতিরা, রুদ্র এবং অন্য সকলকেই ,যদিও তারা তা জানে না,কারন তারা আমার মায়াশক্তির দ্বারা বিমোহিত।
ভগবদগীতায় (১০/২) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষীণাং চ সর্বশঃ।।
অর্থাৎ,মহর্ষিরা ও দেবতারা আমার উৎপত্তি অবগত হতে পারে না, কেন না, সর্বতোভাবে আমিই দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ।
অথর্ববেদের পিপ্পলাদ শাখার অন্তর্গত গোপাল তাপনী উপনিষদে শ্রীকৃষ্ণের নাম, তার ধাম, পরিকর ও লীলাবিলাসের বর্ণনা করে বহু মন্ত্র রয়েছে। এখানে আমরা সেখান থেকে কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত করলাম:
গোপাল তাপনী (পূর্ব ভাগ ১২/১৩) বলা হয়েছে-
গোপবেশমবভ্রাতং তরুণং কল্পদ্রমাশ্রিতম।
সৎপুণ্ডরীক-নয়নং মেঘাভং বৈদ্যুতম্বরম্।
দ্বিভুজং মৌনমুদ্রাঢ্যং বনমালিনমীশ্বরম্।।
তিনি গোপ-বেশধারী, সমুদ্রের ন্যায় অপার, তরুণ অর্থাৎ নব যৌবনান্বিত ও কল্পতরুমূলে উপবিষ্ট, নির্মল পুন্ডরীকাক্ষ, মেঘ-কান্তি, পীতবসন, দ্বিভুজ-মূর্তি,জ্ঞান-সমুদ্রধার, বনমালা-বিভূষিত এবং সকলের ঈশ্বর-"শ্রীকৃষ্ণ।
গোপাল তাপনী উপনিষদে (৩/২) বলা হয়েছে-
একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্যঃ"-সেই পরম ধামে কেবল এক পরম পুরুষোত্তম ভগবান আছেন, যাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ।
গোপাল তাপনী উপনিষদে (১/১) এবং হয়শীর্ষ পঞ্চরাত্রে উল্লেখ আছে-

সচ্চিদানন্দরূপায় কৃষ্ণায়াক্লিষ্টকারিণে।
নমো বেদান্ত বেদ্যায় গুরবে বুদ্ধিসাক্ষিণে।।
অর্থাৎ, আমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করি যার রূপ সচ্চিদানন্দময়। তিনি বেদান্ত বেদ্য, তিনি জগদগুরু এবং আমাদের সকল কর্মের সাক্ষী।

গোপালতাপনী উপনিষদে (২৩) আরো বলা হয়েছে-
জন্ম-জরাভ্যাং ভিন্ন স্থানুর্য়ম অচ্ছেদ্যোহয়ং যোহসৌ সূর্যে তিষ্টতি।
যোহসৌ গোষু তিষ্টতি যোহসৌ গাঃ পালয়তি যোহসৌ গোপেষু তিষ্টতি।।
অর্থাৎ, ভগবান বাসনারহিত। তিনি ষড়বিধ পরিবর্তন যথা-জন্ম, মৃত্যু, ক্ষুধা, তৃষ্ণা জরা এবং দুঃখ দ্বারা প্রভাবিত হন না। তিনি পরমব্রহ্ম এবং তার রূপ অক্ষয়। তিনি সূর্যমণ্ডলে অবস্থান করেন। তিনি তাঁর গোপসখাদের সাথে কামধেনুদের চারণ করেন এবং তাদের রক্ষা করেন। তিনি সূর্য-তনয়া যমুনার কুঞ্জে লীলাবিলাস করেন। এমনকি স্বয়ং মৃত্যুও তাঁকে ভয় পায়। সেই পরম পুরুষোত্তম ভগবান হলেন শ্রী গোবিন্দ।
ছান্দোগ্য উপনিষদে (৮/১৩/১)
"শ্যামাচ্ছবলং প্রপদ্যে শবলাচ্ছ্যামং প্রপদ্যে।
অর্থাৎ,কৃষ্ণ-চিদানন্দময় ধাম লাভ করা যায়
 বিলাস-বৈচিত্র্য-পূর্ণ অপ্রাকৃত সেবা হতে
 এবং কৃষ্ণ-প্রাপ্তি হয়ে থাকে সেই বিচিত্রতা-পূর্ণ চিৎ-জগৎ হতে।
বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, "যত্রাবতীর্ণং কৃষ্ণাখ্যং পরমব্রহ্ম নরাকৃতিঃ" অর্থাৎ পরমব্রহ্ম, যিনি কৃষ্ণ নামে পরিচিত, তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তার মনুষ্যোচিত লীলাবিলাস করেছেন।

ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের শতনাম স্তোতে বলা হয়েছে-
নব-ব্রজ-জনানন্দী সচ্চিদানন্দ-বিগ্রহ
 অর্থাৎ,ব্রজবাসীদের আনন্দ বর্ধিত করেন
 সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ।
'কৃষ্ণ' নামের অর্থ প্রকাশ করে মহাভারতে (উদ্যোগ পর্ব ৭১/৪) বলা হয়েছে-
কৃষর্ভূ-বাচক শব্দো নশ্চ নিবৃত্তি-বাচকঃ।
তয়োর্ত্রৈক্যং পরং ব্রহ্ম কৃষ্ণ ইতি অভিধীয়তে।।
অর্থাৎ 'কৃষ্' শব্দটি ভগবানের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য' এবং 'ণ' মানে চিন্ময় আনন্দ 'ণ' অক্ষরের পূর্বে 'কৃষ্' ক্রিয়া যুক্ত হয়ে কৃষ্ণ শব্দটি গঠিত হয় যা পরমব্রহ্ম কে নির্দেশ করে।
গৌতমীয় তন্ত্রেও (২/৬০) একই রকম কথা বলা হয়েছে-
কৃষিশব্দস্য সত্তার্থো ণশ্চানন্দ স্বরূপকঃ।
সুক-রূপো ভবেৎ আত্মা ভাবানন্দময়স্ততঃ।।
অর্থাৎ 'কৃষ্' শব্দটি সত্তা বা সত্যকে নির্দেশ করে এবং 'ণ' অক্ষরটি স্বাভাবিক আনন্দের প্রতীক। কৃষ্ণ শব্দের অর্থ কি?   সহজভাবে কৃষ্ণ বলতে যিনি  সকলকে আকর্ষণ করেন এবং তাদের আনন্দ প্রদান করেন।

বেদে ভগবান কে পুরুষোত্তম নামেও অভিহিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১৫/১৮) শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-
যস্মাৎ ক্ষরমতীতোহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ।
অতোহস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ।।
অর্থাৎ- যেহেতু আমি  বাজড়জগতের বদ্ধ জীবঅতীত এবং চিন্ময় জগতের মুক্ত জীব থেকেও উত্তম, সেই হেতু জগতে ও বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত।
শ্রীকৃষ্ণই সকল জীবের পিতা ভগবদ্ গীতায় (১৪/৪) তিনি বলেছেন-
সর্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্তয়ঃ সম্ভবন্তি যাঃ।
তাসাং ব্রহ্ম মহদ্ যোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা॥
অর্থাৎ- হে কৌন্তেয় ! সকল যোনিতে যে সমস্ত মূর্তি প্রকাশিত হয়, ব্রহ্মরূপী যোনিই তাদের জননী-স্বরূপা এবং আমি তাদের বীজ প্রদানকারী পিতা।
সমস্ত বৈদিক যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধান করা। এ প্রসঙ্গে ভগবদগীতায় (৯/২৪) শ্রীকৃষ্ণে বলেছেন-
অহং হি সর্বযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ।
ন তু মামভিজানন্তি তত্ত্বেনাতশ্চ্যবন্তি তে॥
অর্থাৎ- আমিই সকল যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু। কিন্তু যারা আমার চিন্ময় স্বরূপ জানে না, তারা আবার সংসার সমুদ্রে অধঃপতিত হয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্বিশেষ ব্রহ্মেরও উৎস। ভাগবদ গীতায় (১৪/২৭) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঘোষণা করেছেন-
ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য চ।
শাশ্বতস্য চ ধর্মস্য সুখস্যৈকান্তিকস্য চ।।
অর্থাৎ-অমিই নির্বিশেষ ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয়। অব্যয় অমৃতের, শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের আমিই আশ্রয়।
ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৪০) বলা হয়েছে-
যস্য প্রভা প্রভবতো জগদন্ডকোটি কোটিস্বশেষবসুধাদিবিভূতি ভিন্নম।
তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমেষভূতং গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।

অর্থ-অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডে অনন্ত বসুধাদি বিভূতির দ্বারা যিনি ভেদপ্রাপ্ত হয়েছে সেই পূর্ণ, নিরবিচ্ছিন্ন এবং অশেষভূত ব্রহ্ম যার প্রভা, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দ কে আমি ভজনা করি।
অনেকে মনে করে যে কৃষ্ণ সমস্ত দেবতাদের উৎস হলেও চরমে তিনি নির্বিশেষ ব্রহ্ম থেকে আসেন। যারা এই রূপ ধারণা পোষণ করে, কৃষ্ণ ভগবদগীতায় (৭/২৪) তাদের অবুদ্ধয় বা বুদ্ধিহীন বলে ঘোষণা করেছেন-
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্॥
অর্থাৎ- বুদ্ধিহীন মানুষেরা, যারা আমাকে জানে না, মনে করে যে, আমি পূর্বে অব্যক্ত নির্বিশেষ ছিলাম, এখন ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছি। তাদের অজ্ঞতার ফলে তারা আমার অব্যয় ও সর্বোত্তম পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয়।
এমনকি উপনিষদেও স্বীকার করা হয়েছে যে, নির্বিশেষ জ্যোতির পেছনে একজন পরম পুরুষোত্তম ভগবান রয়েছেন। যেমন ঈশোপনিষদের (১৫) নং মন্ত্রে বলা হয়েছে-
হিরন্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তৎ ত্বং পৃষন্নপাবৃনু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।
হে ভগবান হে সর্বজীব পালক! জ্যোর্তিময় আলোক আপনার মুখারবিন্দকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। কৃপা করে এই আচ্ছাদন দূর করুন এবং আপনার শুদ্ধ ভক্তকে আপনার স্বরূপ প্রদর্শন করুন।
সেজন্য কৃষ্ণ ব্রহ্ম থেকে আসে নি, ব্রহ্ম কৃষ্ণ থেকে আসে। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, সমুদ্রে যেমন অসংখ্য ঢেউ আসে তদ্রুপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে অবতার প্রকাশিত হয়। এসকল অবতার মূলত ছয় প্রকার- পুরুষাবতার, লীলাবতার, গুণাবতার, যুগাবতার, মন্বন্তর অবতার ও শক্ত্যাবেশ অবতার। অনন্ত অবতার থাকলেও মূল এবং স্বয়ং ভগবান হলেন শ্রীকৃষ্ণ।
এতে চাংশকলা পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ংম।
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ান্তি যুগে যুগে।।
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৩/৩৮)
ভগবানের এই সমস্ত অবতারেরা শ্রীকৃষ্ণের অংশ অথবা কলা (অংশের অংশ)। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায় তখন অাস্তিকদের রক্ষার জন্য ভগবান এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন।।
দ্বাদশ মহাজনের অন্যতম ভীষ্মদেব পান্ডবদের উদ্দেশ্যে কি বলেছেন?-(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৯/১৮)
এষ বৈ ভগবান সাক্ষাদাদ্যো নরায়ণ পুমান্।
মোহয়ন্ময়য়া লোকং গূড়শ্চরতি বৃষ্ণিষু।।
এই শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সাক্ষাৎ ভগবান। তিনি নারায়ণদের নারায়ণ, পরম ভোক্তা। কিন্তু তিনি তাঁর সৃষ্ট মায়াশক্তির প্রভাবে আমাদের মোহিত করে বৃষ্ণিকুলেরই একজনের মতো তাঁদের মাঝে বিচরণ করছেন।।
তদ্রুপ ব্রহ্মসংহিতার বলা হয়েছে-
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।
অনাদির্রাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্।।
(ব্রহ্মসংহিতা-৫/১)
অর্থাৎঃ- শ্রীকৃষ্ণ, যিনি গোবিন্দ নামেও পরিচিত, তিনি হচ্ছেন পরম ঈশ্বর। তাঁর রূপ সচ্চিদানন্দময়। তিনি হচ্ছেন সব কিছুর পরম উৎস। তাঁর কোন উৎস নেই, কেন না তিনি হচ্ছেন সমস্ত কারণের পরম কারণ।।

বৈদিক সাহিত্যে নারায়ন ও বিষ্ণুর নামই সাধারণতঃ বেশি লক্ষ করা যায়। এর কারণ হচ্ছে সৃজন পালন ও সংহার কাজে শ্রীকৃষ্ণ কখনোই প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন না। তিনি এসব হতে সর্বদাই দূরে অবস্থান করেন এবং তার নিজ দামে নিরন্তর লীলাবিলাস উপভোগ করেন। তিনি জড় ব্রহ্মাণ্ডের সকল কার্যাবলী সম্পাদন করেন তার প্রকাশ সমূহের মাধ্যমে, তার পুরুষ অবতার আদি অনন্য অবতারের মাধ্যমে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, মনে করুন আপনি কয়েকটি কোম্পানির মালিক কিন্তু আপনাকে সে জন্য প্রত্যেক কোম্পানিতে ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে ততত্ত্বাবধান করতে হয় না। প্রত্যেক কোম্পানিতে কোম্পানির কার্যাবলী পরিচালনার জন্য আপনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগ করেছেন, তারাই সব কিছু তথ্য প্রদান করেছে, আর আপনি বাড়িতে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে আরাম করছেন আনন্দ উপভোগ করছে। কখনো কখনো আপনি যেকোনো একটি কোম্পানি পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
সেজন্য আপনি একটি ফোন কল করেন এবং সেখানে পৌঁছান। যখন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আপনাকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে যান, তখন সেখানকার কর্মচারীরা অনেকেই আপনাকে নাও চিনতে পারে। তারা হয়তো ভাববে যে আপনি একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি, গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকার ব্যক্তি হয়তো ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সরকারি।

ঠিক তেমনি যখন শ্রীকৃষ্ণ এউ জড় জগতের কোন ব্রহ্মাণ্ডে অবতীর্ণ হন, তিনি বিষ্ণুর মাধ্যমে আসেন এবং সেজন্য অনেক সময় অনেকে তাকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করে। কিন্তু তা সত্য নয়। কোম্পানির সকল ফাইলে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের স্বাক্ষর থাকে, তিনি নিয়মিত অফিসে আসেন সকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তাই ম্যানেজিং ডিরেক্টর কে সকলেই জানে। কিন্তু মালিক যেহেতু সরাসরি কোম্পানির পরিচালনা কাজে সংশ্লিষ্ট নন, তিনি নিয়মিত অফিসে আসেন না, তাই সবাই মালিককে চিনে না।
তেমনি বিষ্ণু জড় জগতের সকল কার্যে জড়িত তাই বৈদিক শাস্ত্রে বিষ্ণু, নারায়ণ প্রভৃতি নাম প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। কিন্তু কৃষ্ণ হচ্ছেন আসল মালিক সমগ্র বিষ্ণুতত্ত্ব প্রকাশগণ তার থেকেই আসেন।
ব্রহ্মসংহিতা (৫/৩৯) বলা হয়েছে-
রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন্
নানাবতারমকরোদ্ভুবনেষু কিন্তু ।
কৃষ্ণঃ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্ যো
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
অর্থাৎ- কলা বিভাগে রাম, নৃসিংহ, বরাহ আদি নানা মূর্তিতে ভগবান জগতে নানা অবতার প্রকাশ করেছিলেন; কিন্তু যে পরম পুরুষ স্বয়ং কৃষ্ণরূপে প্রকট হন, সেই আদি-পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
কৃষ্ণের পরমেশ্বরত্বের অনেক প্রমান থাকা সত্বেও যারা মূঢ় তারা তাকে একজন সাধারন মানুষ বলে মনে করে। এ প্রসঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় বলেছেন-
অবজানন্তি মাম্ মূঢ়াঃ মানুষীম্ তনুম্ আশ্রিতম্।
পরম্ ভাবম্ অজানন্তঃ মম ভূত মহেশ্বরম্।।
(গীতা-৯/১১)
অর্থাৎ:- আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে। তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।

বেদ ও শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কঃকল্পিত ধারণা – শ্রীকৃষ্ণ পরমপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান । কিন্তু বেদে ভগবান শ্রীকৃষ্ণর নাম নেই । শ্রীকৃষ্ণ পরবর্তীতে ভগবান রূপে পূজিত হচ্ছেন ।

বেদ শব্দের অর্থ জ্ঞান এবং সেটি ভগবান থেকে প্রকাশিত হচ্ছে । বেদ শাশ্বত ও অপৌরুষেয়ঃ পরম জ্ঞান নিত্য ও কোন মানুষের রচিত নয় । শাস্ত্রীয় ইতিহাস অনুসারে, সৃষ্টির আদিতে ব্রক্ষ্মান্ডের প্রথম জীব স্বয়ম্ভু ব্রক্ষ্মা এই বেদ-জ্ঞান লাভ করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণর নিকট থেকে, তার বেণুধ্বনির মাধ্যমে

যো ব্রক্ষ্মাণং বিদধাতি পূর্ব্বং যো বৈ
বেদাংশ্চ গাপয়তি স্ম কৃষ্ণঃ । (গোপালতাপনী উপনিষদ – ১/২৪)
“যিনি সৃষ্টির আদিতে ব্রক্ষ্মাকে বৈদিক জ্ঞান উপদেশ করেছিলেন এবং পূর্বে বৈদিক জ্ঞান বিস্তার করেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণই ।”

ব্রক্ষ্মসংহিতায় শ্রীকৃষ্ণকে বেদের সারসত্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে (তুষ্টাব বেদসারেণ স্তোত্রেণানেন কেশবম – ৫/২৮) । বেদ অনুসারে, ব্রক্ষ্মা ভগবান শ্রীবিষ্ণু হতে উদ্ভূত, আর শ্রীকৃষ্ণ শ্রীবিষ্ণুরও উৎস । জড় জগতে ভগবানের তিনটি পুরুষাবতার – বিষ্ণুরূপ প্রকাশিতঃ

(১) প্রথম পুরুষাবতারঃ কারণোদকশায়ী বিষ্ণু বা মহাবিষ্ণু – কারণ-উদক সাগরে (Causal Ocean) শায়িত এই মহাবিষ্ণুর বিরাট শরীর থেকে কোটি কোটি ব্রক্ষ্মান্ড (Clusters of universes) প্রকাশিত হয়, মহাপ্রলয়ে (Dissolution) সমস্ত জড় ব্রক্ষ্মান্ডগুলি ধ্বংস হয়ে সূক্ষ্ম জড় উপাদনরূপে (মহত্তত্ব) তাঁর দিব্য শরীরে বিলীন হয় ।

(২) দ্বিতীয় পুরুষাবতারঃ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু – মহাবিষ্ণু নিজেকে কোটি কোটি রূপে বিস্তার করে প্রতিটি ব্রক্ষ্মান্ডে প্রবেশ করে ব্রক্ষ্মান্ডের গর্ভোদকে শয়ন করেন । তারপর ব্রক্ষ্মাকে সৃষ্টি করেন । ব্রক্ষ্মার মাধ্যমে সূর্য ও চতুর্দশ ভুবন বা গ্রহলোকসমূহ (Planetary systems) সৃষ্টি করেন ।

(৩) তৃতীয় পুরুষাবতারঃ – ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু – প্রতি ব্রক্ষ্মান্ডে শ্রীবিষ্ণু নিজেকে অসংখ্য রূপে বিস্তার করে করে জীবসত্তাকে ভগবদধামে ফিরে আসতে সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক জীব হৃদয়ে পরমাত্মারূপে অবস্থান করেন ।

এইভাবে, কোটি কোটি, অসংখ্য অনন্তরূপে ভগবান নিজেকে বিস্তার করেন, কিন্তু তিনি ‘অদ্বৈতম’ (non-dual) তিনি এক ও অভিন্ন এবং সকল রূপের পরম উৎস শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপ, এটিই বৈদিক শাস্ত্রের সিধান্ত । ব্রক্ষ্মসংহিতায় বলা হয়েছে (৫/৩৩) –
অদ্বৈতম-অচ্যুতম-অনাদিম-অনন্তরূপম
আদ্যং পুরাণপুরুষং নবযৌবনঞ্চ ।
বেদেষু দুর্লভম-অদুর্লভম-আত্মভক্তৌ
গোবিন্দম-আদি পুরুষং তমহং ভজামি ।।
“যিনি অদ্বৈত, অচ্যুত, অনাদি, অনন্তরূপসম্পন্ন, আদি পুরাণপুরুষ হয়েও নিত্যনবনবায়মান যৌবনসম্পন্ন সুন্দর পুরুষ, বেদাদি শাস্ত্র পাঠে দুর্লভ কিন্তু শুদ্ধ আত্মভক্তির লভ্য, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।”

বেদে সর্বদেবতার উপাস্য ভগবান রূপে শ্রীবিষ্ণুকে স্তুতি করা হয়েছে, যেমন ঋগবেদে (১/২২/২০) বলা হয়েছে –
ওঁ তদবিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা
পশ্যন্তি সূরয়ো দিবীব চক্ষুরাততম ।
তদবিপ্রাসো বিপন্যবো জাগৃবাংষঃ
সমিন্ধতে বিষ্ণোর্যৎ পরমং পদম ।।
“পরমেশ্বর বিষ্ণুই হচ্ছেন পরম সত্য । সুরগন তাঁর পাদপদ্ম দর্শনে সর্বদাই উদগ্রীব । সূর্যের মতোই ভগবান তাঁর শক্তিরশ্মির বিস্তার করে সর্বত্র ব্যাপ্ত আছেন ।”

ঋগবেদে ১/২২/১৭, ১/২২/১৮, ১/১৫৪/১, ১/১৫২/২, ১/১৫৪/৩, ১/১৫৪/৪, ১/১৫৪/৬ নং মন্ত্রে বিষ্ণুর কথা বলা হয়েছে ।

অথর্ববেদে বলা হয়েছে, যো ব্রক্ষ্মাণং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ গাপয়তি স্ম কৃষ্ণঃ । অর্থাৎ – “ব্রক্ষ্মা, যিনি পূর্বকালে জগতে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেন, সেই জ্ঞান তিনি সৃষ্টির আদিতে যাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত হন তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ ।”

শ্রীবিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণেরই প্রকাশ বা বিস্তার, শাস্ত্রের সিধান্ত, যেমন সকল বেদ উপনিষদের সার গীতোপনিষদ, ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণু বলে সম্বোধন করা হয়েছে – শমং চ বিষ্ণো(১১/২৪), প্রতপন্তি বিষ্ণো – (১১/৩০), আদিত্যানাম অহং বিষ্ণু(১০/২১) ইত্যাদি । শ্রীকৃষ্ণই শ্রীবিষ্ণুরূপে সর্বজীবের অন্তরস্থিত পরমাত্মা – অহমাত্মা গূঢ়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ(১০/২০) । বিষ্ণুমূর্তি-সমূহ, রাম-নৃসিংহ ইত্যাদি অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণরই প্রকাশ, অংশ, কলা । শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান (এতে চাংশ কলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্ত ভগবান স্বয়ম – ভাগবতম ১/৩/২৮) । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণপরাৎপর পুরুষ, সেজন্য তাঁর থেকে অসংখ্য ভগবৎ-রূপ বিস্তার হলেও তিনি তাঁর পূর্ণস্বরূপে নিত্যবিরাজমান । শ্রীঈশোপনিষদে যেমন বলা হয়েছে (১-আবাহন)
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।
“পরমেশ্বর ভগবান সর্বতোভাবে পূর্ণ । তিনি সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ বলে এই দৃশ্যমান জগতের মতো তাঁর থেকে উদ্ভূত সব কিছুই সর্বতোভাবে পূর্ণ । যা কিছু পরম পূর্ণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে তা সবই পূর্ণ । কিন্তু যেহেতু তিনি হচ্ছেন পরম পূর্ণ, তাই তাঁর থেকে অসংখ্য অখন্ড ও পূর্ণ সত্তা বিনির্গত হলেও তিনি পূর্ণরূপেই অবশিষ্ট থাকেন ।”

মন্তব্যঃ দুটি ব্যাখ্যার আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত আপনারাদের কাছে আশা রাখি।যদি কেউ সঠিক তথ্য জেনে থাকেন তবে কমেন্ট করে জানাবেন প্লিজ।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>