ঈশ্বর কেন এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন

ঈশ্বর কর্তৃক জগৎ সৃষ্টির কারণ কী? 

👉ব্যাখ্যা ১=এটি আমাদের অনেক কমন প্রশ্ন। ঈশ্বর কেন এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন?বিষয়টি খুব বিস্তৃত এবং গড় ব্যক্তির পক্ষে বোধগম্য নয়, তাই এই নিবন্ধটি খুব সংক্ষিপ্তভাবে এবং বস্তুগত বিশ্ব তৈরির প্রক্রিয়া এবং এই ঘটনার অর্থকে সরল করেছে। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদ অনুসারে, একটি আধ্যাত্মিক জগৎ এবং একটি বস্তুগত জগত রয়েছে, যেখানে আমরা এখন আছি। আপনি আধ্যাত্মিক জগত সম্পর্কে পড়তে পারেন, যেমনটি বেদে বর্ণিত হয়েছে, একটি ছোট পর্যালোচনাতে আধ্যাত্মিক জগতের স্বর্গের ছবি এবং ঈশ্বরের রাজ্যের বর্ণনা।" আমরা এর খুব সুন্দর ব্যাখ্যা পাই যা যোগ দর্শনে পতঞ্জলি মুনি করে গেছেন( ত্রৈতবাদ অনুযায়ী) । 

যেকোনো কাজের তিনটি কারণ থাকে। 


নিমিত্ত কারণ, উপাদান কারণ, সাধারণ কারণ।

নিমিত্ত কারণ হল কর্তা (who) , উপাদান কারণ কর্ম (what), সাধারণ কারণ হল কার জন্য (why)।

ঈশ্বর কেন এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন
ঈশ্বরের মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য 


সহজভাবে বোঝালে, যদি একটা বাড়ির নির্মাণকে কার্য ধরি, তো মিস্ত্রি সেই বাড়ির নিমিত্ত কারণ, উপাদান কারণ ইট, বালু, সিমেন্ট, রড আর সাধারণ কারণ সেই বাড়িতে যারা থাকবে তারা।

ত্রৈতবাদ মতে সাধারণ কারণ হল জীবাত্মা। কেননা ঈশ্বর নিজে এই জগৎকে কখনোই ভোগ করেন না। কাজেই এই জগতের সৃষ্টি জীবাত্মার ভোগের নিমিত্ত। 


সূত্র - তদর্থ এব দৃশ্যস্যা ঽঽত্মা। (যোগ দর্শন ২।২১)


শব্দার্থ - (তদ্-অর্থঃ)অপবর্গের জন্য (এব) অবশ্যই (দৃশ্যস্য) দৃশ্যের (আত্মা) স্বরূপ হয় বা ওই জীবাত্মার ভােগ। 


সূত্ৰাৰ্থ - অপবর্গকে সিদ্ধ করার জন্য হয় ও দৃশ্যের স্বরূপ জীবাত্মার ভােগ।


উপরের সুত্র গুলোর সমাধান - এই সূত্রে দৃশ্যের কী প্রয়ােজন; সেই বিষয়ে বলা হয়েছে এই দৃশ্যের রচনা ঈশ্বর, যাতে জীবাত্মা ভােগ এবং অপবর্গ রূপ প্রয়ােজনকে সিদ্ধ করতে পারে সেই জন্য করেছেন। এই সংসারে তিনটি পদার্থ রয়েছে ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি। ঈশ্বর সকল কামনা হতে রহিত; তাই তাঁর কাছে এই দৃশ্যের কোনাে প্রয়ােজন নাই। প্রকৃতি একটি জড়পদার্থ হওয়ায় সে নিজেকে স্বয়ং ভােগ করতে পারে না। কিন্তু জীবাত্মার নিজস্ব কোনাে আনন্দ না থাকায় সে এই দৃশ্যকে ভােগ করে। 

সুত্রঃ যোগ দর্শন ভাষ্য- আচার্য কপিল আর্য।

ব্যাখ্যা ২=

ঈশ্বর কেন এই বিশ্ব,পৃথিবী,প্রানীজগত প্রভৃতি সৃষ্টি করলেন?

আব্রাহামিক ধর্মালম্বীরা উত্তর দেয় যে সৃষ্টিকর্তা নাকি তার ইবাদত করার জন্য আমাদের সৃষ্টি করেছেন!যদি তাই হয়ে থাকে তবে সৃষ্টিকর্তা উপাসনালোভী একজন শক্তিশালী শাসক ছাড়া আর কিছুই নন।বৈদিক ঈশ্বর উপাসনালোভী কোন ব্যক্তি নন।তিনি মহত্তম আর যিনি মহত্তম তিনি কারো ইবাদতের লোভে লালায়িত হননা,ইবাদত না করলে দোযখে নিক্ষেপ করেন না।  🔹তাহলে কেন ঈশ্বর এই মহাবিশ্ব,প্রানীজগত সৃষ্টি করলেন? কেননা মহান বৈদিক ঈশ্বর ইচ্ছা(সংকল্প) করলেন যে তিনি বহুর মাঝে,সকলের মাঝে বিচরন করবেন,সকলের হৃদয়ে।এ বিষয়ে ছান্দেগ্য উপনিষদের একটি শ্লোক অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মতভাবে এই বিষয়টি ব্যখ্যা করছে- 

 ★★তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোহসৃজত। তত্তেজ ঐক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি। তদপোহসৃজত। (ছান্দেগ্য উপনিষদ ৬.২.৩)  #অনুবাদ- "তত্‍-পরমাত্মা,ঐক্ষত-ইচ্ছা করলেন/সংকল্প করলেন, বহু স্যাম্--আমি বহু হই, প্রজায়েয়েতি-আমি বহুর মাঝে প্রকাশিত হই,এর পরের অংশটুকু বৈজ্ঞানিক বিগ ব্যাং তত্ত্বের অসামান্য বর্ননা, তত্‍-পরমাত্মা(তখন),তেজ অসৃজত-তাপের সৃষ্টি করলেন(বিগ ব্যাং এ ও একইভাবে প্রথমেই প্রচুর তাপ উত্‍পন্ন হয়),তারপর তত্‍ অপঃ অসৃজত-তারপর জলের সৃষ্টি হল(পৃথিবীর আদি পর্যায়,বিজ্ঞানের ভাষায় প্রাথমিক লার্ভা)  #একইভাবে_বলছে_তৈত্তিরীয়_উপনিষদ-  "সোহকাময়ত্‍ বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি... তদেবানুপ্রাবিশত্‍।।"  অর্থাত্‍ পরমাত্মা ইচ্ছা করলেন যে তিনি বহুর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হবেন তাই তিনি প্রথমে তাপের সৃজন করলেন,সেখান থেকে পরে তরলের সৃজন হল,এর পর ধীরে ধীরে সমস্ত সৃষ্টি হল এবং সকল কিছুতে ব্যপ্ত হয়ে তিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশিত হলেন। 

 ★ত্রি॒পাদূ॒র্ধ্ব উদৈ॒ৎপুরু॑ষঃ॒ পাদো॑ঽস্যে॒হাভ॑ব॒ৎ পুনঃ॑।ততো॒ বিষ্ব॒ঙ্ ব্যক্রামৎসাশনানশ॒নেঽঅ॒ভি॥৪॥  

★পদ পাঠ ত্রিপাদিতি ত্রিঽপাৎ। ঊর্ধ্বঃ। উৎ। ঐৎ। পুরুষঃ। পাদঃ। অস্য। ইহ। অভবৎ। পুনরিতি পুনঃ॥ ততঃ। বিষ্বঙ্। বি। অক্রামৎ। সাশনানশনেঽইতি সাশনানশনে। অভি॥৪॥  যজুর্বেদ ৩১/৪  🔸পূর্বোক্ত (ত্রিপাৎ) তিন অংশের (পুরুষঃ) পালক পরমেশ্বর (ঊর্ধ্বঃ) সর্বোত্তম মুক্তিস্বরূপ সংসার থেকে পৃথক (উৎ , ঐৎ) উদয়কে প্রাপ্ত করে। (অস্য) এই পুরুষের (পাদঃ) এক ভাগ (ইহ) এই জগতে (পুনঃ) বার-বার উৎপত্তি-প্রলয়ের চক্র থেকে (অভবৎ) হয় (ততঃ) এরপর (সাশনানশনে) খাদক (?) চেতন এবং অখাদক(?) জড় এই দুয়ের (অভি) প্রতি (বিষ্বঙ্) সর্বত্র প্রাপ্ত হয়ে (বি, অক্রামৎ) বিশেষভাবে ব্যাপ্ত হয় ॥৪॥  

★সেই পুরুষ এই সৃষ্ট জগত থেকে পৃথক তিন অতি মহান অংশ দ্বারা প্রকাশিত যেখানে তার মহত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্বের এক অংশ বার বার এই জগৎ সৃজন করছে এবং এই স্থাবরজঙ্গমাদি সমস্ত জগতে এবং জগতকে অতিক্রম করেও ব্যপ্ত হয়ে আছে।  #ভাবার্থ :-  যে পূর্বোক্ত পরমেশ্বর কার্য জগৎ থেকে পৃথক তিন অংশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, তার এক অংশ নিজসামর্থে পুরো জগৎকে বার বার উৎপন্ন করে, পশ্চাতে ঐ চরাচর জগতে ব্যাপ্ত হয়ে স্থিত থাকে। 

🌵🌺🐡 ★★বেনস্তৎপশ্যন্নিহিতং গুহা সদ্যত্রবিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম। তস্মিন্নিদং সং চ বি চৈতু সর্বেং স আোতঃ প্রোতশ্চ বিভু প্রজাসু।। (যজুর্বেদ ৩২/৮)  

🌺🔹" জ্ঞানি ব্যাক্তিরা সেই পরমাত্মাকে জ্ঞান দৃষ্টিতে দর্শন করেন যার মধ্যে এই সমগ্র জগত অাশ্রয় গ্রহণ করেছে। তার মধ্যেই এই সমগ্র জগত একত্রে মিলিত হয় এবং তার মধ্যে হতেই তা বিছিন্ন হয়।"

🌺  🌺🔸অর্থাৎ তার মধ্য হতেই বিস্ফোরণের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে জগত সৃষ্টি হয় আর তার মধ্যেই অন্তে সংকুচিত হয়ে সমগ্র জগত আবার মিলিত হয়ে যায়!

🌺  ♻️🌺এখানে একটি মজার তথ্য দিয়ে রাখি।এই মন্ত্রের 'যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম' অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের মোটো লাইন যার অর্থ 'যেখানে সমগ্র বিশ্বের নীড়' বা 'সমস্ত বিশ্ব যেখানে মিলিত'। 

🌺 🌌🌺আমরা যেখান থেকে এসেছি অন্তে সেখানেই আবার ফিরে যাব,আবার নতুন করে শুরু হবে সৃষ্টি,এভাবে পুনঃপুনঃ সৃষ্টি-ধ্বংসের মাধ্যমে অনাদি-অনন্ত পরমেশ্বরের সাথে অনাদি প্রকৃতি ও জীবাত্মাও বর্তমান থাকবে।তাই গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন,  ★★ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।  ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্।। (ভগবদগীতা ২.১২)  🔹অর্থাৎ এমন কোন সময় ছিলনা যখন তুমি বা আমি ছিলাম না,আর এমন কোন সময় থাকবেনা যখন তুমি বা আমি থাকবনা।শুধু পরিবর্তন হবে স্থিতির।পরিবর্তন ই এই ধ্রুব জগতের নিয়ম।  ★★ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচম।  হেতুনানেন কৌন্তেয় জগদ বিপরিবর্ততে।। ৯/১০  

🔸অর্থঃ-হে কৌন্তেয়! আমার অধ্যক্ষতায় প্রকৃতি এক এই সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করে এবং এই জন্যই জগৎ বারবার আবর্তিত হয়।  [শব্দার্থঃ অধ্য অধ্যক্ষতায় = তত্ত্বাবধানে । আবর্তিত= ঘুরছে এমন]  বেদ বলে প্রকৃতি পরমাত্মা ও জীবাত্মা এই তিনটি অনাদি সত্ত্বা, ঈশ্বরের সৃষ্টি সৃজন করেছেন একে নিজের থেকে বা অভাব থেকে সৃষ্টি করেননি, বিজ্ঞান আজ এই বৈদিক সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি ভাবে মেনে নিয়েছেন,  (Matter can neither be created nor it can be destroyed) #না_প্রকৃতিকে_জন্ম_দেওয়া_যেতে_পারে_না_একে_নষ্ট_করা_যেতে_পারে_শুধু_রূপান্তরিত_হয়। 

🌼 🔲🌼তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন আসে যে বৈদিক ধর্মালম্বীদের কেন ঈশ্বরের উপাসনা করা উচিত যেহেতু ঈশ্বর উপাসনালোভী নন এবং এজন্য তিনি কাউকে শাস্তি দেননা? প্রথমত,বলা হয় যার স্তুতি করা হয়,যার সাথে বা যার বৈশিষ্ঠ্যে চিন্তা প্রভাবিত হয় তার গুন বা বৈশিষ্ঠ্যগুলোই নিজের মধ্যে আয়ত্ত হয়,বিকশিত হয়।ঈশ্বরের স্তুতি,ঈশ্বর চিন্তায় সময়যাপন করলে তাঁর ন্যায় দয়ালুতা,কর্মশীলতা, ন্যায়পরায়নতা প্রভৃতি গুন জন্মে।এতে মানবচরিত্রের উন্নতি সাধিত হয়।  

🌼🌼🔸দ্বিতীয়ত,উপাসনা করতে গেলে যম,নিয়ম,ইন্দ্রিয়সংযম প্রভৃতি যোগাচার পালন করতে হয়।এতে শারীরিক,মানসিক ও নৈতিক,সকল ধরনের বৈশিষ্ঠ্যেই উত্তরন ঘটে।  

পরিশেষে মন্তব্য করা যায় যেহেতু ঈশ্বর জগৎ ও জীবনের সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি সুন্দর ও পবিত্র। তিনি রয়েছেন বিশ্বময়। তিনি শূন্যতা থেকে সমস্ত কিছুই সৃষ্টি করেছেন এবং তা করেছেন তাঁর গৌরবের জন্য । ঈশ্বরের সব সৃষ্টিই উত্তম। তাঁর সকল সৃষ্টির মাঝে রয়েছে একটি পারস্পরিক যোগাযোগ ও নির্ভরশীলতা । সৃষ্টির প্রতি যত্ন নেওয়া মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সৃষ্টিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আমরা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পাড়ি তাই না? ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>