শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা ষষ্ঠ অধ্যায় অভ্যাসযােগ

শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা ষষ্ঠ অধ্যায় অভ্যাসযােগের প্রথম শ্লোকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন – কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া যিনি কর্তব্য - কর্ম করেন , তিনিই সন্ন্যাসী , তিনিই যােগী । যিনি যজ্ঞাদি - সর্ববিধ শারীরকর্ম ত্যাগ করিয়াছেন বা শ্রৌতকর্ম ত্যাগ করিয়াছেন নতুবা তিনি নহেন ।
# নিরগ্নিঃ — অগ্নিসাধ্য শ্রৌতকর্মত্যাগী । ধর্মশাস্ত্রে উক্ত আছে যে , সন্ন্যাসাশ্রমীর অগ্নি রক্ষা করিবার প্রয়ােজন নাই । তিনি ‘ নিরগ্নি ’ হইয়া সর্বকর্ম ত্যাগ করিয়া ভিক্ষাদ্বারা শরীর রক্ষা করিবেন ।
যজ্ঞাদি - শ্রৌতকর্ম ত্যাগ করিয়া যতিবেশ ধারণ করিলেই সন্ন্যাসী হয় না , অথবা সর্ববিধ শারীরকর্ম ত্যাগ করিয়া অর্ধমুদিত নেত্রে অবস্থান করিলেই যােগী হয় না , ভিতরের ত্যাগই ত্যাগ , বাহিরের ত্যাগকে ত্যাগ বলে না । যিনি নিষ্কামকর্মী তিনিই সন্ন্যাসী ও যােগী ; কেননা , সন্ন্যাস ও যােগের ফল যে সমচিত্ততা , ফলকামনাত্যাগ হেতু কর্মযােগী তাহা লাভ যজ্ঞাদি - শ্রৌতকর্ম ত্যাগ করিয়া যতিবেশ ধারণ করিলেই সন্ন্যাসী হয় না , অথবা সর্ববিধ শারীরকর্ম ত্যাগ করিয়া অর্ধমুদিত নেত্রে অবস্থান করিলেই যােগী হয় না , ভিতরের ত্যাগই ত্যাগ , বাহিরের ত্যাগকে ত্যাগ বলে না । যিনি নিষ্কামকর্মী তিনিই সন্ন্যাসী ও যােগী ; কেননা , সন্ন্যাস ও যােগের ফল যে সমচিত্ততা , ফলকামনাত্যাগ হেতু কর্মযােগী তাহা লাভ করেন ।

শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা ষষ্ঠ অধ্যায় অভ্যাসযােগ
অভ্যাসযোগ ছবি


এই অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন যে , অষ্টাঙ্গযােগ হচ্ছে মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করার একটি পন্থাবিশেষ । তবে এই যােগ সকলের পক্ষে অনুশীলন করা কষ্টকর , বিশেষ করে এই কলিযুগে তা অনুশীলন করা এক রকম অসম্ভব । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অধ্যায়ে অষ্টাঙ্গ - যােগের পদ্ধতি বর্ণনা করে অবশেষে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছেন যে , কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম বা কর্মযােগ অষ্টাঙ্গযােগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । এই জগতের সকলেই তার স্ত্রী , পুত্র , পরিজনের ভরণ - পােষণের জন্য কর্ম করে । ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা ভােগবাঞ্ছা ব্যতীত কেউই কোন কর্ম করে না । কিন্তু সাফল্যের মানদণ্ড হচ্ছে কর্মফলের প্রত্যাশা না করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য কর্ম করা । প্রতিটি জীবই ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ , তাই ভগবানের সেবা করাই হচ্ছে তাদের একমাত্র কর্তব্য । শরীরের বিবিধ অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ শরীরের পালন - পােষণের জন্য কর্ম করে , তাদের আংশিক স্বার্থের জন্য নয় । তেমনই , যে মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে পরব্রহ্মের তৃপ্তির জন্য কর্ম করেন , তিনি হচ্ছেন প্রকৃত সন্ন্যাসী এবং প্রকৃত যােগী ।
ভ্রান্তিবশত , কিছু সন্ন্যাসী মনে করে যে , তারা সব রকম জাগতিক কর্তব্য থেকে মুক্ত হয়েছে এবং তাই তারা অগ্নিহােত্র যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করা ত্যাগ করে । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা স্বার্থপরায়ণ , কারণ তাদের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বিশেষ ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করা। এই সমস্ত বাসনা জাগতিক কামনা থেকে মহত্তর হলেও তা স্বার্থশূন্য নয় । ঠিক তেমনই , সব রকমের জাগতিক ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাগ করে , অর্ধনিমীলিত নেত্রে যােগী যে তপস্যা করে চলেছেন , তাও ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত । তিনিও তাঁর আত্মতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষার দ্বারা প্রভাবিত । কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্তই হচ্ছেন একমাত্র যােগী , যিনি পরমেশ্বরের তৃপ্তিসাধন করার জন্য নিঃস্বার্থভাবে কর্ম করেন । তাই , তাতে একটুও স্বার্থসিদ্ধির বাসনা থাকে না । শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধান করাটাই তাঁর সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি , তাই , তিনিই হচ্ছেন যথার্থ যােগী , যথার্থ সন্ন্যাসী । বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রার্থনা করেছেন তা হলো ন-ধনং,ন-জনং, ন- সুন্দরীং, কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে এই বলে প্রার্থনা করেন।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি।।
“ হে জগদীশ্বর ! আমি ধন কামনা করি না , আমি অনুগামী কামনা করি না এবং আমি সুন্দরী স্ত্রী কামনা করি না । আমার একমাত্র কামনা হচ্ছে , আমি যেন জন্ম - জন্মান্তরে তােমার প্রতি অহৈতুকী ভক্তি লাভ করতে পারি । ”
পঞ্চম অধ্যায়ের ২৭-২৮ শ্লোকে সংক্ষেপে ধ্যানযােগের উল্লেখ করা হইয়াছে । এই অধ্যায়ে পরে সেই ধ্যানযােগের বিস্তারিত আলােচনা করা হইয়াছে , কিন্তু উহা কর্মযােগেরই অঙ্গরূপে উদ্দিষ্ট হইয়াছে । এই জন্যই এই কয়েকটি শ্লোকে , কর্মযােগের যে মূল কথা — ফলসন্ন্যাস , কামনা - ত্যাগ ও তজ্জনিত সমচিত্ততা , তাহাই প্রথমে বর্ণিত হইয়াছে এবং পরে উহা লাভের উপায়স্বরূপ ধ্যানযােগ বা সমাধিযােগের বর্ণনা করা হইয়াছে ।
অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ৷
স-সন্ন্যাসী, চ-যোগী, চ- ন নিরগ্নির্ন, চাক্রিয়৷৷১॥
ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে..
সবাইকে সাথে থাকার অনুরোধ রইলো
জয় শ্রী কৃষ্ণ


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>