হিন্দুধর্মে নারীরা কি ব্রহ্মচর্য তথা সন্ন্যাস পালন করতে পারে? ব্রহ্মচারিণী ও ব্রহ্মবাদিনী কি?

বৈদিক যুগে নারীরা সুপণ্ডিত ছিলেন তার বহু প্রমাণ আমরা বেদ থেকে পাই। প্রকৃতপক্ষে নারীদের তপস্বী জীবন বৈদিক পরবর্তী যুগেও লুপ্ত হয়নি।  রাজা জনকের নিকট তপস্বীনি ভিক্ষুণী সুলভার আধ্যাত্মিক আলোচনা মহাভারতের অত্যুজ্জ্বল অংশ। রামায়ণে রামচন্দ্রের সাথে সাক্ষাৎরতা ঋষি শবরীকে সুপণ্ডিত ও তপস্বিনী বলা হয়েছে। দ্রৌপদীর রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক আলোচনাগুলো মহাভারতের অন্যতম নারী বিদুষীর স্বাক্ষর বহন করে।  ৪০০ খ্রি. পূর্বে ভারত ভ্রমণকালে মেগাস্থিনিস চিরকৌমার্য পালনরতা অনেক সুপণ্ডিত নারীকে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন- বহু নারী বিদ্বান চিরকুমার পুরুষ ঋষিদের মত চিরকৌমার্য অবলম্বন করিয়া শাস্ত্রচর্চা করিতেন এবং ঋষিদের সহিত শাস্ত্রবিচার করিতেন।  ব্রহ্মচর্য সমাপান্তে যুবতীগণকে যোগ্য যুবকের সহিত বিবাহ দেওয়া হইত। যজুর্বেদ, ৮/১  রমণীগণ জীবনের দ্বিতীয় আশ্রম অর্থাৎ গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশের পূর্বে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার সহিত ব্রহ্মচর্য পালন করিতেন। অথর্ববেদ, ১১/৬  শাণ্ডিল্য এবং গর্গ্যের কন্যাকে মহাভারতে ব্রহ্মচারিণী নামে অভিহিত হয়েছেন।  ব্রহ্মচর্য সমাপান্তে যে নারীগণ গার্হস্থে প্রবেশ করতেন তাঁদের ব্রহ্মচারিণী বলা হয়, আর যাঁরা চিরকৌমার্য অবলম্বন করতেন তাঁরা ব্রহ্মবাদিনী বলে মর্যাদা পেতেন।

হিন্দুধর্মে নারীরা কি ব্রহ্মচর্য তথা সন্ন্যাস পালন করতে পারে? ব্রহ্মচারিণী ও ব্রহ্মবাদিনী কি?
নারীরা ব্রহ্মচর্য করছেন 


ব্রহ্মচারিণীঃ ব্রহ্মচারিণী’ নামের অর্থ ‘ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বনকারিণী’। তিনিই উমা।  দেবী ব্রহ্মচারিণী দ্বিভুজা; একহাতে তাঁর জপমালা, অপর হাতে কমণ্ডলু। দেবী জ্যোতির্ময়ী মূর্তিতে আবির্ভূতা; তাঁর ভৈরব চন্দ্রমৌলীশ্বর।  দেবী ব্রহ্মচারিণীর সম্পর্কে যে পৌরাণিক উপাখ্যানটি প্রচলিত, সেটি গিরিরাজ হিমালয়ের গৃহে জাত দেবী পার্বতীর শিবকে পতিরূপে লাভ করার নেপথ্য-কাহিনি। সতীর দেহত্যাগের পর শিব ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন। তাই সতী যে পুনরায় পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেদিকে খেয়াল ছিল না তাঁর। এদিকে তারকাসুরের অত্যাচারে দেবতারা জর্জরিত। সে বর পেয়েছিল, শিবের পুত্র ভিন্ন অপর কেউই তাকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারবে। কিন্তু শিব বিবাহের নামটি করছিলেন না। তখন উপায়? অগত্যা নারদ পার্বতীকে তপস্যা করার পরামর্শ দিলেন। নারদের উপদেশ মতো প্রথমে এক হাজার বছর শুধুমাত্র ফলমূল খেয়ে, তারপর একশো বছর শুধু শাক খেয়ে, তারপর কিছুকাল উপবাস করে, তারপর তিন হাজার বছর শুধুমাত্র একটি করে বেলপাতা খেয়ে এবং শেষে কয়েক হাজার বছর নির্জলা উপবাস করে পার্বতী করলেন কঠোর তপস্যা। মা মেনকা দুর্গার তপস্যাক্লিষ্ট শরীর দেখে দুঃখিত হয়ে কন্যাকে নিরস্ত করার জন্য বললেন, “উ মা” (আর না!) সেই থেকে দেবী ব্রহ্মচারিণীর অপর নাম হল ‘উমা’। তাঁর কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা এসে তাঁকে বর দিলেন, “যাঁকে তুমি কামনা করো, সেই শিবকেই পতিরূপে পাবে।“ মহামায়া দুর্গার সেই তপস্বিনী রূপই দেবী ব্রহ্মচারিণী। দেবীপুরাণ মতে, সর্ববেদে বিচরণ করেন বলে দেবী পার্বতীর অপর নাম ‘ব্রহ্মচারিণী’। কাশীতে তাঁকে ‘ছোটি দুর্গাজি’ও (ছোটো দুর্গা) বলা হয়।  রামায়ণ অনুসারে, উমা পর্বতরাজ হিমালয়ের দ্বিতীয়া কন্যা (প্রথমা কন্যা হলেন গঙ্গা)। তিনি তপস্বিনীর জীবন যাপন করতেন। হরিবংশ মতে, হিমালয়ের ঔরসে মেনকার গর্ভে তিন কন্যার জন্ম হয়–অপর্ণা, একপর্ণা ও একপাটলা। এঁরা তিন জনই কঠোর তপস্যা করেছিলেন। একপাটলা একটি মাত্র নাগকেশর ফুল খেয়ে, একপর্ণা একটি মাত্র পাতা খেয়ে এবং অপর্ণা কিছু না খেয়ে তপস্যা করেন। অপর্ণার এহেন কঠোর তপস্যায় বিচলিত হয়ে তাঁর মা মেনকা তাঁকে বলে বসেন, ‘উ মা!’ (আর না!) সেই থেকে দেবী অপর্ণার পরিচিতা হন ‘উমা’ নামে। তিন বোনের মধ্যে উমাই ছিলেন শ্রেষ্ঠা; তিনি পতিরূপে লাভ করেন মহাদেবকে। তবে মনে হয়, তিন বোনের তপস্যার এই কাহিনি থেকেই বাংলা লৌকিক ছড়ায় শিব ঠাকুরের বিয়েতে তিন কন্যা দানের প্রসঙ্গটি এসেছে। আবার, তন্ত্রমতে, যে দেবী ব্রহ্মের প্রতিনিধিস্বরূপ দেবতাদের দর্পচূর্ণ করতে গিয়েছিলেন, তাঁরও নাম উমা হৈমবতী।  কাশীর (বারাণসী) দুর্গাঘাটের কাছে রয়েছে দেবী ব্রহ্মচারিণীর মন্দির। মন্দিরটি বেশ ছোটো। দেবীপ্রতিমার উচ্চতাও হাত খানেক। তবে পূর্বমুখী এই মূর্তির মুখে সোনার মুখোশ লাগানো থাকে। শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রি উৎসবে দ্বিতীয় দিনে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়।  দেবী ব্রহ্মচারিণী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন। তাঁর পূজা করলে শুধু সংযম ও মানসিক শক্তিই বৃদ্ধি পায় না, সাধক অনন্ত পুণ্যফলও লাভ করেন এবং তিনি সর্বদা সিদ্ধি ও বিজয়ও লাভ করেন। নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে সাধক নিজের মনকে স্বাধিষ্ঠান চক্রে স্থিত করে ব্রহ্মচারিণীর পূজা করেন।


ব্রহ্মবাদিনীঃপ্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী প্রাচীনকালে ভারত উপমহাদেশের নারীরা খুব স্বাধীনচেতা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী ছিলেন। শুনলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, পুরুষতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও তখন ছিল না। মনে করা হয়, অবাধে খোলা চত্বরে বসে স্ত্রী-পুরুষ একত্রে জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা-তর্ক করতে পারতেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, যে সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক সুকুমারী ভট্টাচার্যি বিষদভাবে বর্ণনা করেছেন, প্রাচীনকালে, বিশেষ করে বৈদিক যুগের শেষ দিকে, ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা প্রচুর পরিমাণে অবদমিত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে। আর এই অবদমনের ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে শাস্ত্রীয় ও সাহিত্য গ্রন্থ এবং ঐতিহ্যে-কিংবদন্তিতে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ সেই যুগের অন্যতম প্রধান ব্রহ্মবাদিনী, বিদুষী গার্গী এবং তাঁর প্রতি পুরুষ পণ্ডিতের ব্যবহার। খ্রিস্টের জন্মের ৭০০ বছর আগে জন্ম তাঁর। শুধু জ্ঞান সাধনা ও চর্চায় ডুবে থাকার সংকল্প নিয়ে আজীবন অবিবাহিত ছিলেন বচক্নু ঋষির এই ব্রহ্মবাদিনী কন্যা গার্গী। গার্গী নামক এই জ্ঞানতাপসীকে বলা যায় অধুনিক শিক্ষিতা নারীর, বিশেষ করে অবিবাহিতা পেশাজীবী নারীদের পথিকৃৎ, যাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ মহা ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন, “স্তব্ধ হও”।প্রাচীন ভারতে বিশেষত পরবর্তী বৈদিক যুগের পর দুই শ্রেণির শিক্ষিত মহিলাদের কথা জানা যায়। যে মহিলারা সারাজীবন বেদ অধ্যয়ন করতেন, “তাদের ব্রহ্মবাদিনী বলা হত। অন্যদিকে যে মহিলারা বিবাহের আগে পর্যন্ত বেদ অধ্যয়ন করতেন তাদের সদ্যোবাদ বলা হত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>