সন্ন্যাসী কত প্রকার ও কি কি? কারা প্রকৃত সন্ন্যাসী?

শ্রমের মধ্যে দিয়ে ৫০ বছরের পর বাণপ্রস্থে যেতে হতো অতীতে সকল আর্যকেই এবং শেষ জীবনে সন্ন্যাস নিতে হতো। এরপর আস্তে আস্তে ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ব্রম্মচর্য পালনের পর একদল সংসারে ও একদল মুষ্টিমেয় মান্ন্যাসের পথে যাওয়া শুরু করল। ৫০বছর বয়সে বাণপ্রস্থে যাওয়ার বদলে ৬০ বছরে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে নূতন বাড়ি তৈরিতে মন দিচ্ছেন বা ছেলে বৌমা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছেন!হয় সংসার মানুষকে ত্যাগ করে নয় মানুষ সংসার ত্যাগ করে ! কিন্তু তাঁরাই কেবল সন্ন্যাস গ্রহণ করেন যাঁহারা সংসার বিরাগী হন জগৎ সংসারের অস্থায়ীত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে। 

নাগা সন্ন্যাসী
নাগা সন্ন্যাসী 

ব্রম্মচর্য হলো এর প্রথম পর্যায় হল । এটা চতুরাশ্রমের ব্রম্মচর্য বা গুরুগৃহে বিদ্যার্জন নয়,আত্মসংযমের অনুশীলন। এরপর গুরু উপযুক্ত মনে করলে সন্ন্যাস দান করেন। সন্ন্যাস গ্রহণকালে নূতন নামকরণ হয়।এর পূর্বে বিরজাহোম করে আত্ম (নিজের) শ্রাদ্ধ করতে হয়। পার্থিব পরিচয় ত্যাগ করতে হয়। নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মার মুক্তি ও জগতের কল্যাণে সমর্পণ করতে হয়। প্রচুর কঠোর অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।যেমন ১২ বছর পর একবার মাত্র ছাড়া কখনো নিজের সংসারে ফিরে আসতে নেই। পূর্ব পরিচয় দিতে নেই। এক জায়গায় তিনরাত্রি বাস করতে নেই। নারী দেহ,মূর্তি বা চিত্র (নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষ) স্পর্শ পর্যন্ত করতে নেই! কারোর সঙ্গে মায়ার বাঁধনে জড়াতে নেই। কাম কে সম্পূর্ণভাবে জয় করতে হয়। সংযম,দেহ-মনের পবিত্রতা, শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ,ধ্যান অভ্যাস ও নিত্য অনিত্য বিচার করে ঈশ্বরে/ব্রহ্মে মন স্থির করতে হয়। এইভাবে কঠোর অনুশাসন অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে একজন সন্ন্যাসী ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে জীবন্মুক্ত হয়ে যান। হিন্দু ধর্মে পুনর্জন্মবাদ একটি স্তম্ভ।মানুষ ব্রহ্মসাজুয্য লাভ করেন বা ব্রহ্মে লীন হয়ে যান সেই অনুসারে একমাত্র মোক্ষলাভ করলেই  কর্মফল ভোগ এবং পুনর্জন্ম ভোগ থেকে মুক্ত হয়ে থাকে। 

 অনেক "ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতী" — এই শ্লোকের এইরকম অপব্যাখ্যা করে যে মানুষ ঈশ্বরে পরিণত হয়। এটা অনেকটা এক বিন্দু জল সমুদ্রে এসে মেশার মতো। দুটিই স্বরূপত এক হলেও মাত্রাগত পার্থক্য আছে। আর সনাতন ধর্মে সন্ন্যাসের মর্যাদা সবথেকে উপরে। যে কেউ সন্ন্যাস নিলে জাতিগত পরিচয় (শিখা সুত্র বা টিকি ও পৈতা ত্যাগ করতে হয়। সংসারীদের মতো কাছা দিয়ে ধুতি পরা চলে না,নিজের নামে পূজার সংকল্প করা ইত্যাদি নিষেধ!) আর থাকে না। পূর্বে সন্নাসীরা সংঘবদ্ধ ছিল না।শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য দশনামী সম্প্রদায় সৃষ্টি করে সকল সন্ন্যাসীদের এর অন্তর্ভুক্ত করেন। এই দশটি সম্প্রদায় গিরি,পুরী,ভারতী ইত্যাদির মধ্যেই সকল সন্ন্যাসী পড়েন। শাক্ত,শৈব,বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা কেউ কেউ স্বীকার করেন না এবং নানকপন্থী, জৈন-স্বেতাম্বর ও দিগম্বর এবং বৌদ্ধ মহাযান,হীনযান ও বজ্রযান সম্প্রদায় এর বাইরে।

সন্ন্যাসী কত প্রকার ও কি কি? কারা প্রকৃত সন্ন্যাসী?

তাৎপর্যঃ অনাদিকাল ধরে সন্ন্যাস আশ্রমীরা ত্রিদন্ড ধারণ করে আসছেন। পরবর্তীকালে শংকরাচার্য একদন্ডী সন্ন্যাস প্রবর্তন করেন। ত্রিদন্ডী সন্ন্যাসী হচ্ছেন বৈষ্ণব সন্ন্যাসী এবং একদন্ডী সন্ন্যাসী হচ্ছে মায়াবাদী সন্ন্যাসী। অন্যান্য আরও অনেক প্রকার সন্যাসী রয়েছে, যাদের বৈদিক বিধিতে অনুমোদন করা হয়নি। পৃথু মহারাজের মহান পুত্র বিজিতাশ্বের আক্রমণ থেকে লুকাবার জন্য ইন্দ্র যে ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন, তার ফলে এক প্রকার কপট সন্ন্যাসীর প্রবর্তন হয়েছে। সেই থেকে এখন নানা প্রকার কপট সন্ন্যাসী দেখা দিয়েছে। তাদের কেউ উলঙ্গ হয়ে থাকে এবং কেউ নরকপাল ও ত্রিশূল ধারণ করে। সাধারণত তাদের বলা হয় কাপালিক। এক অর্থহীন পরিস্থিতি থেকে সেগুলির প্রবর্তন হয়েছে। যারা মূর্খ, তারাই এদের সন্ন্যাসী বলে মনে করে এবং এদের ভণ্ডামিকে ধর্ম আচরণ বলে মনে করে। এরা কখনোই পারমার্থিক পথপ্রদর্শক নয়।

এখন কতকগুলি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও, যাদের বৈদিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক নেই, তারা এক প্রকার সন্ন্যাসী তৈরি করেছে যারা পাপপুণ্য কার্যকলাপে যুক্ত থাকে। যে সমস্ত পাপ কর্ম শাস্ত্রে নিষিদ্ধ হয়েছে সেগুলি হচ্ছে -অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ, আসব পান, আমিষ আহার এবং এই সমস্ত তথাকথিত সন্ন্যাসীরা এই সব ক'টি অপকর্মে লিপ্ত হয়। তারা মাংস, মাছ, ডিম এবং প্রায় সব কিছুই খাই, কখনও কখনও কখনো তারা সূরাও পান করে এবং তাদের অজুহাত হচ্ছে যে, মাছ, মাংস এবং মদ না খেলে মেরুপ্রদেশের নিকটবর্তী ঠান্ডা দেশগুলিতে থাকা অসম্ভব। এই সমস্ত সন্ন্যাসীরা দরিদ্রদের সেবা করার নামে এ সকল অপকর্মের প্রচলন করে, যার ফলে নিরীহ পশুদের বধ করা হয়, যাতে সেগুলির দ্বারা সেই সমস্ত সন্ন্যাসীদের উদরপূর্তি হতে পারে। এই সমস্ত সন্ন্যাসীদের পাখন্ডি বলে বর্ণনা করা হয়েছে।  পুরাণে বলা হয়েছে-
যস্ত্ত নারারয়নং দেবং ব্রহ্মারুদ্রাদিদৈবতৈঃ।
সমত্বেনৈব বীক্ষেত স পাষন্ডী ভবেদ্ ধ্রুবম্।।

অর্থাৎ  তারাই পাষন্ডী যারা নারায়ণকে শিব অথবা ব্রহ্মার সমকক্ষ বলে মনে করে ।আসল সন্ন্যাসী হলেন তিনি,যিনি জগতের অনিত্যতা উপলব্ধি করে জগতের মঙ্গলের জন্য আত্মনিবেদিত। তিনি গেরুয়াধারী হন বা সংসারী সেজে থাকুন! 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
"/>
"/>
"/>
"/>